প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | অদৃশ্য দেয়াল
মিষ্টির কথা শুনে মেঘের চোখের তারাগুলো ঝলমল করছে। চোখের সামনে আবিরের হাস্যোজ্জল চেহারা ভেসে উঠেছে। ওমনি মেঘ চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। চোখ বন্ধ করা মাত্র আবিরের ধারালো ছু*রির ন্যায় দৃষ্টি চোখে লাগল। বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডটা ছুটে পালাতে চাচ্ছে, সহসা অনুভব হলো উষ্ণ হাওয়া মেঘের কানের লতি ছুঁয়ে গেছে। মেঘের লুকানো অনুভূতিগুলো আজ আকাশে ডানা মেলে উড়তে চাচ্ছে, আনন্দ সাথে লজ্জায় মেঘের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। বন্যা সুনিপুণ নজরে খেয়াল করল তা, বন্যার ঠোঁটে সহসা হাসি ফুটলো। হাসিমুখে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” কেউ আবির ভাইয়াকে খবর দে, বান্ধবী আমার নববধূর মতো লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে। আবির ভাইয়া না আসলে বোধহয় চোখ তুলে তাকাবেই না।” বন্যার কথায় মেঘের হুঁশ ফিরে৷ স্পষ্ট চোখে তাকায় বন্যার দিকে৷ বন্যার হাস্যোজ্জল মুখ দেখে মেঘ এগিয়ে এসে বন্যাকে জড়িয়ে ধরে লজ্জায় ওড়না দিয়ে মুখ লুকালো। বন্যা ক্ষীণ স্বরে বলল, “বেবি! থাক এত লজ্জা পাইতে হবে না। আমরা তো আর আবির ভাইয়া নয়!” মিষ্টি বলল,
” মেঘ তুই ওনাকে পেলে সত্যি ই অনেক ভালো থাকবি । আমি মাত্র কয়েক ঘন্টা ওনার দায়িত্বশীলতা আর যত্ন দেখেই ক্রাশ খেয়ে ফেলছি সেখানে তুই তো নিজে সর্বক্ষণ সবকিছু অনুভব করিস।” মিনহাজ শক্ত গলায় বলে উঠল, “তোদের আহ্লাদ দেখে বাঁচি না। এই বন্যা মেঘের ফোনটা দে, আমার আইডি আনব্লক করি।” মেঘ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বন্যার থেকে নিজের ফোন নিয়ে ব্যাগে রাখতে রাখতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” কোনো প্রয়োজন নেই৷ তুই ব্লকলিস্টেই থাক।” “কেনো?”
“আবির ভাই নিজের হাতে ব্লক দিছেন, আমার পক্ষে আনব্লক করা দুরূহ বিষয়৷ তাছাড়া আমাকে বেবি বলতে বারণ করা স্বত্তেও তুই বেবি ডাকছিস। আমি কিছুই করতে পারবো না। ” ” এত পাথর মন কেন তোর? আনব্লক করে দে৷ আর বলব না। ” “সম্ভব না। আমি বাসায় যাব। টা টা। ” মেঘ খুশিতে গদগদ হয়ে সবাইরে রেখে চলে গেছে । গাড়িতে বসে ভাবছে, “আবির ভাই কি সত্যিই আমায় পছন্দ করেন? নাকি আমি একটু বেশিই ভাবছি!” মেঘ বাসায় এসে হাতমুখ ধৌয়ে নিচে আসছে। মালিহা খান সোফায় বসে কি যেন পড়তেছিলেন। মেঘকে ঘুরঘুর করতে দেখে ডাকলেন,
“মেঘ, এদিয়ে আয়” বড় আম্মুর ডাক শুনে মেঘ সোফায় এসে বসতেই মালিহা খান মৃদু স্বরে বললেন, “খাবি কিছু?” “না খিদে নেই৷” “তাহলে ঘুরতেছিস যে” “আম্মুরা কোথায়?” “তোর আম্মু, কাকিয়ারা শপিং এ গেছে।” মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, ” আমায় নিয়ে গেল না কেন?” ” তুই যেতিস নাকি?” “হ্যাঁ”
“আজকে আর কিভাবে যাবি৷ তুই বরং অন্যদিন যাস। আমি খেতে দিচ্ছি তুই ঠান্ডা মাথায় খেয়ে নে।” মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ” তোমার খেতে দিতে হবে না। আমি একায় খেতে পারবো। ”
মেঘ মন খারাপ করে রান্না ঘরে চলে গেছে। রাস্তায় আসতে আসতে মেঘ ভাবছিল শপিং এ গিয়ে আবিরের জন্য নিজে পছন্দ করে পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে আসবে কিন্তু আম্মুরা মেঘকে না বলেই চলে গেছে। মেঘ খাবার খেয়ে রুমে এসে শুয়ে আছে। মাথায় শুধু আবির ভাই ঘুরছে। শুয়ে বসে কোনোভাবেই ভালো লাগছে না। কয়েকবার ফোনে আবিরের নাম্বার বের করেছে কিন্তু কল দেয়ার সাহস পাচ্ছে না। কোনোভাবেই যখন ঘুম আসছিল না তখন মেঘ উঠে চুপিচুপি আবিরের রুমে চলে গেছে। রুম জুড়ে মাতাল করা এক সুগন্ধ যা মেঘের মস্তিষ্কের নিউরনে অনুরণন তুলছে। চারপাশে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ নজর পরে আবিরের স্কাই ব্লু রঙের এক শার্টের দিকে। মেঘ নিঃশব্দে হেসে এগিয়ে গেল শার্টের কাছে।
শার্ট টা কাছে আনতেই আবিরের গায়ের গন্ধ স্পষ্ট নাকে লাগলো। আবেশে মেঘের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। প্রিয় মানুষের স্পর্শ যেমন দেহ আর মন উভয়কে আন্দোলিত করে তেমনি প্রিয় মানুষের গায়ের গন্ধেও তীব্র আকর্ষণ কাজ করে। মেঘ কিছুক্ষণ শার্টটাকে জড়িয়ে ধরে অকস্মাৎ জামার উপরে শার্ট টা পড়ে নিল৷ আবিরের শার্ট মেঘের গায়ে অনেকরা পাঞ্জাবির মতো লাগছে, যেমন মোটা তেমনি লম্বা। মেঘ ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই লজ্জায় দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছে। খানিক বাদে দু আঙুল ফাঁক করে এক চোখে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। খুশিতে দুহাত মেলে রুমে ঘুরতে লাগলো, ঘুরতে ঘুরতে ধপ করে বিছানায় এসে বসে পরেছে। দুহাতে শার্টের কলার ঠিক করে হাতা টেনে বিছানায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করল৷ চোখে ভাসছে গত ৯ মাসে আবিরের সঙ্গে কাটানো একের পর এক অপরূপ মুহুর্ত। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে মেঘ নিজেও জানে না৷
আবির বিকেলের দিকে বাসায় আসছে। রুমে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালো, নিজের বিছানায় মেঘকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আশেপাশে তাকিয়ে সম্পূর্ণ রুম ভালোভাবে নিরীক্ষণ করল৷ ব্যাগ টা রেখে কয়েক মুহুর্ত প্রখর নেত্রে রইলো প্রেয়সীর অভিমুখে। ঘুমের মধ্যেও মেঘের ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই আছে। মেঘের পরনে নিজের শার্ট দেখে মুচকি হাসলো । আবিরের নিষ্পলক দৃষ্টি আঁটকে আছে মেঘের ঘুমন্ত চেহারায়। আনমনে অনেককিছু ভেবে নিয়েছে। মেঘকে ডাকার জন্য একবার এগিয়ে গেল কিন্তু মেঘের গভীর ঘুম দেখে ডাকতে ইচ্ছে করে নি। তাই শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে চলে গেছে।
শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েও দেখল মেঘ ঘুমে নিমগ্ন হয়ে আছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মনের ভেতর অস্থিরতা, মস্তিষ্কে বিচরণ করছে নানান রঙবেরঙের নিষিদ্ধ প্রেমানুভূতি। ইচ্ছে করছে প্রেয়সীর চাঁদের ন্যায় মুখবিবরে ভালোবাসার পরশ একেঁ দিতে কিন্তু কিভাবে সম্ভব! আবিরের প্রেয়সী যে এখনও অবুঝ। আবির ঠোঁটে হাসি রেখে মেঘের দিকে ঝুঁকে এসে চুল ঝাড়তেই, পানির ছিটা মেঘের চোখেমুখে পরে। মেঘ ঘুমের মধ্যেই ভ্রু কুঁচকালো কিন্তু সজাগ হওয়ার কোনো নাম ই নিল না।
আবির রুম থেকে বেরিয়ে বেলকনিতে গেল, বাসার পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। মীমরা এখনও ফিরে নি, মালিহা খান নিজের রুমে। আবির আবারও রুমে আসছে। মেঘের দিকে ভালোভাবে তাকাতে পারছে না আবার না তাকিয়েও থাকতে পারছে না৷ অন্যদিকে বাসার মানুষের চিন্তা তো আছেই৷ হুট করে কেউ চলে আসলে আর মেঘ কে এ ভাবে আবিরের রুমে দেখলে কি হবে তাই ভেবে পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত মেঘের মাথার কাছে বসে, মেঘের চুলে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে মোলায়েম কন্ঠে ডাকলো,
“মেঘ” মেঘ ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। আবির পুনরায় ডাকলো, “মেঘ” মেঘ ঘুমের মধ্যেই বলবো, “ওমমমমম” “উঠ”
মেঘ এবার ঠাস করে চোখ মেলল৷ আবিরের চোখে চোখ পরতেই আশেপাশে চোখ ঘুরালো। এটা আবিরের রুম বুঝতে পেরেই তাড়াহুড়ো করে উঠে বসলো। আবির ভাইয়ের বিছানায় ঘুমিয়ে পরেছিল ভেবেই লজ্জায় মেঘ চোখ তুলে তাকাতে পারছে না৷ মেঘের আকাশচুম্বী লজ্জা দেখে আবির থমথমে কন্ঠে বিড়বিড় করল, ” রাগ উঠতে এই লজ্জা কোথায় হারায় যায়? ” মেঘ উঠে চলে যেতে নিলে আবির মেঘের বাহু চেপে ধরে। সদ্য ঘুম ভাঙায় মেঘ কথাও বলতে পারছে না। আবির দাঁড়িয়ে মেঘের কাছে এগিয়ে এসে শুধালো, “এসবের মানে কি?”
মেঘ আবিরের দৃষ্টি খেয়াল করে নিচে তাকাতেই রীতিমতো কেঁপে উঠলো। পরনে আবিরের শার্ট দেখে মেঘের শরীর ঘামতে শুরু করেছে। ভয় আর লজ্জায় মেঘ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ চিবুক নামিয়েছে গলায়। কিছু বলার ভাষা নেই। মেঘের অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরে আবির মেঘকে ছেড়ে দিয়েছে৷ মেঘ সঙ্গে সঙ্গে দরজার দিকে ছুটলো৷ বেলকনিতে গিয়ে শার্ট খুলে পুনরায় আবিরের রুমের দরজা পর্যন্ত এসে শার্ট বিছানার দিকে ছুঁড়ে ফেলে নিজের রুমে চলে গেছে। আবির ঠোঁটে হাসি রেখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ পরেই মীমরা শপিং করে বাসায় আসছে। এসেই মেঘকে ডাক শুরু করলো। মেঘের জন্য জুতা, থ্রিপিস আরও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসছে। মেঘ শপিং খুলে দেখছে। একটা শপিং দেখিয়ে বলল, “ঐটাতে কি আছে আম্মু? ” হালিমা খান শপিং ব্যাগটা মেঘের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ” আবির আর তানভিরের জন্য শার্ট আছে এটাতে! ” মেঘ গম্ভীর গলায় বলে,
“পাঞ্জাবি আনো নি?” “পাঞ্জাবি তেমন ভালো লাগে নাই তাই আনি নি৷ ” “ওহ।” হালিমা খান আদিকে পাঠালেন আবিরকে ডাকার জন্য। আবির নিচে আসতেই মেঘ লজ্জায় মীমের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পরেছে। আকলিমা খান আবিরকে ২ টা শার্ট দিয়ে বলল, “দেখো পছন্দ হয় কি না!”
আবির দাঁত বের করে হাসলো। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “তোমাদের পছন্দ কে আমি কখনো খারাপ বলছি?” “তা বলো নি৷ কিন্তু খুব ভালো লাগছে সেটাও কখনো বলো না। তুমি এত বছর বাহিরে ছিলে, তোমার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই৷ তাই একটু চিন্তায় থাকি। ” আবির হেসে বলল,
“তোমরা মাঝে মাঝে এমনভাবে কথা বলো যেন আমি ভিনগ্রহে ছিলাম। নতুন নতুন পৃথিবীতে পা রাখছি। ” আবিরের কথা শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো৷ আবির নিরব দর্শকের মতো সব দেখল। আর মেঘ মীমের আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আবিরকে দেখছে । আবির যতক্ষণ নিচে ছিল, মেঘ সামনেই আসে নি। আবির নিজের শার্ট নিয়ে চলে যেতেই মেঘ আবারও সোফায় বসে শুধালো,
“আম্মু তোমরা আবার শপিং এ যাবে কবে?” “জানি না। কেন মা?” “আমিও শপিং এ যেতাম।” “তোর ড্রেস পছন্দ হয় নি?” “হয়ছে। আমার অন্য কাজ আছে। কবে যাবে বলো।” “আমরা আবার যেতে যেতে ঈদের সময় যাবো। তখন গেলে হবে?” “না আমার ইমার্জেন্সি যেতে হবে। ” “তাহলে তানভির না হয় আবিরের সঙ্গে চলে যাস। ”
আবির এরমধ্যে রুমে শার্ট দুটা রেখে নিচে নামতে নামতে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো, “কোথায় যেতে বলছে?’ “ওর নাকি কি শপিং করতে হবে। তাই বলছিলাম তুই না হয় তানভির নিয়ে যাস। ” “এখন যাবি? ” মেঘ এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে না করল। মেঘ মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, “ওনাদের নিয়ে শপিং এ যাওয়ার চেয়ে না যাওয়ায় ভালো।” আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“আমি বাহিরে যাচ্ছি ফিরতে দেরি হতে পারে। ” বলে আবির চলে গেছে। মেঘ রুমে যেতেই দেখল ফোনে মিনহাজ একের পর এক কল দিচ্ছে। মেঘ ফোন রিসিভ করতেই মিনহাজ বলল, “তুই কি আমায় আনব্লক করবি না মেঘ?” “আমি পারব না।সেটা তোকে আগেই বলেছি। আর এতবার কল দিলে ফোন নাম্বারও ব্লক করে দিব বলে দিলাম।” “থ্রেট দিচ্ছিস মেঘ?” “মনে কর দিচ্ছি। ”
“ঠিক আছে, ভালো থাকিস। রাখছি। ” বাসায় ভালো লাগছিল না বলে আবির আজ রাসেল, রাকিব আর লিমনের সাথে দেখা করতে আসছে। ওরা তিনজনই সিগারেট খাচ্ছিলো। আবির আসতেই লিমন একটা সিগারেট আবিরের দিকে এগিয়ে দিল। আবির শক্ত কন্ঠে বলল, “আমি সিগারেট খায় না৷” রাসেল ফিক করে হেসে বলল, ” মজা করছিস নাকি?” “মজা করার কি হলো?”
লিমন সিগারেট টা আরও এগিয়ে বলল, “আমাদের সাথে ফরমালিটি করতে হবে না। নে খা” “আমি সত্যি খাই না। ” “কবে থেকে?” “অনেকদিন হবে।” “ছাড়লি কেন?” “আমার কাদম্বিনী চাই না আমি সিগারেট খায় ” রাকিব এবার উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“তুই যেন কার জন্য সিগারেট খাওয়া শুরু করছিলি?” “যার ধরেছিলাম তারজন্যই ছেড়েছি। সমস্যা আছে কোনো?” “নাহ। একদম ই না।” রাকিব শুধালো, “বাসার সবাই কেমন আছেন?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ” রাসেল গলা উঁচু করে বলল, ” আংকেল ঠিক আছেন? ” ” আলহামদুলিল্লাহ ” লিমন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, ” তোর এত পরিবর্তনের রহস্য কি?” আবির গম্ভীর গলায় বলে,
” বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হলে এসব পরিবর্তন নিজে থেকেই চলে আসে। চোখে সামনে আব্বু আম্মুর অসুস্থতা, বুকের ভেতর প্রেয়সীর গভীর অনুরক্তি সব আড়াল করতে নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় এই আর কি!” রাসেল শীতল কণ্ঠে বলল, “মেঘের কথা বাসায় জানাবি না?” “কিভাবে জানাবো? আব্বু হার্ট অ্যাটাকের হাত থেকে কোনোরকমে বেঁচে ফিরেছেন৷ এ অবস্থায় আব্বুকে প্রেশার দেয়ার মতো পরিস্থিতি কোনোভাবেই তৈরি করা যাবে না। আর আমার শ্বশুর যে মানুষ, আমার মুখে নিজের মেয়ের নাম শুনলেই আগুনে ঘি ঢালার মতো চেঁতবেন। আবির পুনরায় নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল, “আজ একমাত্র ছেলে না হইতাম। আর একটা ভাই থাকতো তাহলে আমাকে কখনো কোনো কাজে পিছপা হতে হতো না৷ ”
রাকিব করুণ স্বরে শুধালো, “ফুপ্পির বিষয়ে বাসায় কোনো সিদ্ধান্ত হয় নি?” আবির বিরক্তি নিয়ে বলল, “এখনও কিছুই হচ্ছে না৷ আমি আব্বু চাচ্চুকে ইন্ডাইরেক্টলি বলেছি কিন্তু তাদের দিকে থেকে তেমন রেসপন্স পাচ্ছি না। ” “কি ভাবছিস? কি ভাবে কি করবি?” “আমি জানি না। ” আবির অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে বাসায় আসছে। মেঘ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বরাবরের মতো আবিরের জন্য অপেক্ষা করছিল।আবির বাসায় ঢুকতেই দেখল আলী আহমদ খান সোফায় বসে ছিলেন। আবিরকে আসতে দেখে শক্ত কন্ঠে বললেন,
“তোমার সাথে একটু দরকার আছে।” আবির সহসা দাঁড়িয়ে পরেছে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “জ্বি বলুন।” “তোমার ফুপ্পির বিষয়ে কিছু ভেবেছো?” মুখে হাসি নিয়ে আবির বলল, “আমি কি ভাববো?” “তোমার ফুপ্পির বিষয়ে তুমি ভাববে না?এ বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে তোমার তো কিছু দায়িত্ব আছে। ” আবির মলিন হেসে বলল,
“আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন তাই হবে।” আলী আহমদ খান শান্ত স্বরে বললেন, “ঠিক আছে। রুমে যাও তুমি।” আজ মেঘ ভার্সিটিতে আসতেই মিষ্টি উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “কিরে মেঘ আবির ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো?” “কি কথা বলবো?” “মিনহাজকে ব্লক করার কারণ জিজ্ঞেস করিস নি?” মেঘ আমতা আমতা করে বলল, “এত সাহস আমার নেই।”
“সাহস না দেখালে কিছু জানতেও পারবি না।” মেঘের হঠাৎ ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করল, ” ওনি আমায় ভালো না বাসলে কি করব?” তামিম হেসে বলল, ” ওনাকে ভুলে যাবি।” মেঘ ভ্রু কুঁচকে কঠিন স্বরে বলল, “তোরে ভুলে যাব৷ দূর হ হা*রামী। মিনহাজ অভিভূতের ন্যায় নিষ্পলক মেঘের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তোরা অনুমতি দিলে আমি একটা প্ল্যান দিতে পারি।” বন্যা শক্ত কন্ঠে বলল, “কিসের প্ল্যান?”
মিনহাজ ধীর স্থির কন্ঠে সবটা প্ল্যান বলেছে। মিষ্টিরা বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেছে। মিষ্টিদের উত্তেজনা দেখে মেঘও মোটামুটি রাজি হয়েছে । কিন্তু বন্যা কোনো ভাবেই রাজি হচ্ছে না। মেঘকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মিষ্টি, মিনহাজ আর তামিমের কথা শুনতে শুনতে বন্যার কথা মেঘ পাত্তায় দিচ্ছে না৷ রাতে খাবার টেবিলে বড়দের খাওয়া শেষে আবির, তানভির, মীম, মেঘ বসে খাবার খাচ্ছিল। তানভির উঠে যেতেই মেঘ মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” মীম,তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে। ” “কি কথা আপু।” মেঘ বিড়বিড় করে বলল, “আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ডদের কথা বলছিলাম না তোকে। ” “হ্যাঁ। এখন কি হয়ছে?” আবির দীর্ঘ মনোযোগ দিয়ে মেঘের কথা শুনছে। মেঘ ঢোক গিলে ধীর কন্ঠে বলল, “আমার এক ফ্রেন্ড মনে হয় আমাকে পছন্দ করে। তোকে ছবি দেখাব নে। খেয়ে রুমে আসিস। ”
মীম “আচ্ছা” বলে চোখ তুলতেই নজর পরে আবিরের দিকে। আবির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। মীম সে দৃশ্য দেখে টেবিলের নিচ দিয়ে মেঘকে চিমটি কেটে বিড়বিড় করে বলল, “আপু চুপ করো। ভাইয়া তোমার কথা শুনে ফেলছে।” মেঘ মীমের কথায় তেমন পাত্তা না দিয়ে আবারও বলল, “ওরা তোর কথা খুব বলে। তোকে নিয়ে একদিন ওদের সাথে দেখা করতে যাব নে৷ ঠিক আছে? ” ভয়ে মীমের কন্ঠ ভিজে এলো, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“সময় হলে যাব এখন চুপ করো তুমি” মেঘ উত্তেজিত কন্ঠে পুনরায় বলল, ” জানিস মীম, ওর নামের প্রথম অক্ষরও M” আবির সঙ্গে সঙ্গে খাবার রেখে দাঁড়িয়ে পরেছে৷ হালিমা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন, “কিরে খাবার শেষ না করে উঠে পরলি যে?” “খেতে ইচ্ছে করছে না।” “কেন? কি হয়েছে তোর?”
“কিছু না।” আবির রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রুমে চলে গেছে। মেঘ এবার দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখ তুলে তাকালো৷ মেঘের নেত্র দ্বয় টলমল করছে, আবিরের সামনে এভাবে কথা বলা মেঘের কাছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমতুল্য। ভয়ে মেঘের হাত-পা কাঁপছিল, নিচ দিকে তাকিয়ে কোনোরকমে কথাগুলো বলেছে মেঘ। আবির কোনোদিকে না তাকিয়ে রুমে চলে গেছে। মেঘ গভীর রাত পর্যন্ত টিভি দেখেছে আর আবিরের জন্য অপেক্ষা করেছে। প্রায় ১ টা নাগাদ মেঘ রুমে গিয়ে শুয়ে পরেছে।
পরদিন সকালে আবার খাবার টেবিলে আবিরের সঙ্গে দেখা। মেঘ কোনোভাবেই আবিরের চোখের দিকে তাকায় না। কারণ আবির ভাইয়ের চোখে চোখ রাখলেই মেঘের সবকিছু গুলিয়ে যাবে। বড়দের কথার মাঝখানে মীম কি একটা কথা বলেছে কিন্তু কেউ মীমের কথা কানে ই নেয় নি। মেঘ মীমকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে সচেতন কন্ঠে বলল,
“শুন মীম, যেখানে গুরুত্ব পাবি না সেখানে কখনো কোনো কথা বলবি না।যেখানে গুরুত্ব পাবি সেখানেই নিজের মতামত দিবি।” মেঘের বিজ্ঞের ন্যায় কথা শুনে মীম আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে।
পর্ব - ৪৯(২)
মেঘের অধিবিদ্যের ন্যায় কথা শুনে তানভির আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে শুধালো, “বনু, তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? কে তোকে প্রাধান্য দেয় নি বল শুধু! ” মোজাম্মেল খান ভারী কন্ঠে বললেন, ” কেনো তাকে কি করবা?” তানভির ধীর কন্ঠে বলল, ” কিছু করব না। ” মেঘ তানভিরের দিকে তাকিয়ে তটস্থ হয়ে বলল, “এমনি, মীমকে বুঝাচ্ছি। ”
আবিরের আঁখি জোড়া মেঘের পানে গভীরভাবে অনুবন্ধী হয়ে আছে। মেঘ তানভিরের থেকে নজর সরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। মিনহাজের পরিকল্পনায় মেঘ এমন টা করছে যাতে আবিরের মনের ভাব বুঝতে পারে৷ খাবার টেবিলে যে যার মতো খাবার খাচ্ছে অথচ আবিরের দৃষ্টি মেঘেতে স্থির। মেঘ যে ইন্ডাইরেক্টলি আবিরকে খোঁচা দিচ্ছে এটা আবিরের বুঝতে বাকি নেই। মেঘ খাবার খেয়ে চুপচাপ উঠে গেছে। আবির কিছুক্ষণ নিবিড় চিন্তায় মগ্ন থেকে খাওয়া শেষ করে অফিসে চলে গেছে।
আবির আজ অফিসের কাজে কোনোভাবেই মনোযোগ দিতে পারছে না। আবিরের বুকের ভেতর অধৃষ্য হাওয়া বইছে, হৃদয়ের তোলপাড় চলছে৷ এসিতে বসেও শরীর ঘামছে, দুশ্চিন্তায় আবিরের শ্যামবর্ণের চেহারা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। ফাইল এলোমেলো অবস্থায় ফেলে টেবিলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। রাকিব একটা ফাইল নিয়ে রুমে ঢুকে আবিরকে দেখেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল,
“কি হয়ছে আবির? অসুস্থ লাগছে?” আবির টেবিল থেকে মাথা তুলতেই আবিরের অসহায় মুখ দেখে রাকিব ভ্রু কুঁচকে বলল, ” কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছিস?” “মেঘ ইদানীং কেমন জানি ব্যবহার করছে। ” “কেমন করতেছে?” ” ডিরেক্ট কিছু বলে না তবে কেমন জানি ঠ্যাস দিয়ে কথা বলে।” রাকিব মৃদু হেসে বলল,
“তোকে পরীক্ষা করছে হয়তো।” “তা বুঝার বয়স আমার হয়ছে।” “তাহলে দুশ্চিন্তা কি নিয়ে করছিস?” “খোঁচাখোঁচি টা যদি সিরিয়াল রূপ নেয় তার জন্য ভয় হচ্ছে। আমি সেদিন ওর আইডি থেকে মিনহাজ ছেলেটা কে ব্লক করছি। ও তেমন কোনো রিয়াকশন দেখায় নি, আনব্লক ও করে নি। ঠিকই ভার্সিটিতে ঘন্টার পর ঘন্টা ঐ ছেলেগুলোর সাথে আড্ডা দেয়।” রাকিব গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তুই যে এই বিষয় কোনো না কোনোদিন দুশ্চিন্তায় পরবি সেটা আমার অজানা নয়। তোকে কম করে হলেও হাজার বার বলছি। তুই একবার ওদের সাথে পার্সোনাললি দেখা করলে এত কাহিনীর কিছুই হতো না। ” “আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না জানিস তো। এখন পর্যন্ত যে কয়জনকে নিজের হাতে মেরেছি সব কয়টা ত্যাড়ামির জন্য মা*র খেয়েছে। ভালোভাবে কথা বলতে গেলে তারা মানতে চাই না, গায়ের জোর, এলাকার দাপট দেখায়।
সহ্য করতে না পেরে আমার তাদের মা*রতে হয়। মিনহাজদের সাথে দেখা করতে গেলে তারা যে সেইম কাজটা করবে না তার কি গ্যারেন্টি আছে? তীব্র আক্রোশ থেকে দিব মাই-র। কোনো না কোনোভাবে সে কথা মেঘের কানে যাবে। আর মেঘ ভাববে আমি ইচ্ছেকৃত ওর বন্ধুদের মেরেছি আর তা নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটাবে। এমনিতেই ওর সাথে রাগারাগির শেষ নেই এই ঘটনার জের ধরে দেখা যাবে কথা বলায় বন্ধ করে দিয়েছে৷ ” “তানভির বা আমি তো বলতেই পারতাম৷ ”
“হ্যাঁ পারতি। কিন্তু মেঘ ঘুরেফিরে আমাকেই ভুল বুঝতো। কারণ প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন জয় নামের ছেলেটার জন্য ও কে মে-রেছিলাম। এত বছর পর ভার্সিটিতে উঠে দুটা ছেলে বন্ধু হয়েছে এখন মেঘেকে না মেরে ওদেরকে মারা হয়েছে। মেঘ কি এতটায় বোকা যে কিছুই বুঝবে না! তোরা মারলে ছেলেগুলো মেঘকে ডিটেইলসে বলবে, আর কাউকে দিয়ে মারালে সেটাও বলবে। সবভাবেই দোষ গিয়ে আবির আর তানভিরের উপর ই পরবে। ”
“তোর এই সুদূর প্রসারি চিন্তা ভাবনার জন্যই নিজের মনোবল হারাচ্ছিস, দিনকে দিন বদমেজাজি হয়ে যাচ্ছিস, মেঘের সাথে কারণে অকারণে রাগ দেখাচ্ছিস আর এই সুযোগে ছেলেগুলোরও অতি বার বাড়তেছে।” আবির কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আড়চোখে রাকিবের দিকে তাকিয়ে শুধালো, “কেনো আসছিলি?”
রাকিব সঙ্গে সঙ্গে ফাইল এগিয়ে দিল। বাড়তি কথা বাদ দিয়ে কাজে মনোযোগ দিল। অফিস শেষে আবির কিছু স্ট্রিট ফুড আর ২ টা আইসক্রিমের বক্স নিয়ে বাসায় আসছে৷ মেঘ সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল, আবিরকে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসতে বসতে কাকে কল দিল। অপর পাশে কল রিসিভ করা মাত্রই মেঘ হাসিমুখে রাজ্যের গল্প শুরু করেছে। আবির খাবার গুলো ডাইনিং এ রাখতেই মীম আর আদি ছুটে গেল। আবির তির্যকভাবে মেঘের দিকে তাকালো। আবির বাসায় আসছে বা খাবার নিয়ে আসছে সেদিকে মেঘের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে তার কথা বলায় এতটায় মগ্ন যে আশেপাশে তাকানোর সময় ই নেই। আবির কপাল গুটিয়ে সিঁড়ি কাছে চলে গেছে। বাসায় যে যায় আনুক না কেন প্রথম ডাক টা মেঘকেই দেয় আর মেঘ খাবার পরিবেশন করে মীম আর আদিকে নিয়ে খায়। আজ মেঘ কথা বলছে দেখে মীম মেঘের জন্য খাবার নিয়ে আসছে। মেঘের দিকে এগিয়ে দিয়ে কিছুটা উঁচু স্বরে বলল,
“আপু নাও।” মেঘ অন্যদিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলল, “দেখছিস না কথা বলছি। এখন আমার এসব খাওয়ার সময় নেই” আবির সিঁড়ি থেকে সে দৃশ্য দেখে রাগে ধপাধপ পা ফেলে রুমে চলে গেছে। মেঘ ধমকটা মীম কে দিলেও সেটা যেন আবিরের হৃদয়ে গিয়ে লাগছে৷ মেঘ আজ পর্যন্ত এমন কাজ কখনও করে নি৷ বন্যারা কারো সাথে কথা বললেও আবির, তানভির আসলে কথা শেষ করে কল কেটে দিত অথচ আজ তার ভিন্ন রূপ। আবির চলে যেতেই মেঘ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ফোন রাখ, এখন খাবো আমি।” মীম ধমক খেয়ে মন খারাপ করে মেঘের জন্য আনা খাবার আবার নিয়ে গেছে। মেঘ তপ্ত স্বরে বলল, “এই মীম, আমার ভাগ আমায় দিয়ে যা। ” মীম মন খারাপ করে বলল, “তুমি না বললে, তোমার এসব খাওয়ার সময় না” “সময় ছিল না। এখন আমার অফুরন্ত সময়, সবগুলো আমার কাছে নিয়ে আয়।” মীম খাবার গুলো মেঘের কাছে গিয়ে চলে যেতে নিলে মেঘ মীমের হাতে টান দিয়ে মেঘের পাশে বসিয়ে হেসে বলল,
“রাগ করছিস? সরি বাবু ” মীম কিছু বলছে না দেখে মেঘ দুহাতে মীমকে কাতুকুতু দেয়া শুরু করল। সহসা মীমের ছোট্ট দেহ কম্পিত হলো। নড়তে নড়তে বলল, “আপু ছাড়ো।” মেঘ হাসতে হাসতে বলল, “তুই যতক্ষণ না হাসবি ততক্ষণ ছাড়বো না। ”
কাতুকুতু সহ্য করতে না পেরে মীম হাসতে শুরু করলো। মেঘ সঙ্গে সঙ্গে কাতুকুতু দেয়া থামিয়ে দিয়েছে। দু-বোন গল্প করতে করতে আবিরের আনা খাবার গুলো খেয়েছে। আদি নিজের ভাগের খাবার নিয়ে আগেই রুমে চলে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ পর গল্প করতে করতে মেঘ মীমের উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পরেছে। মীম মেঘের চুলে হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “কি হলো আপু?”
মেঘ লাজুক হাসলো আর বলল, “জানিস, আমি একজনের প্রেমে পরেছি!” মীম উত্তেজিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, “সত্যি? কার?” মেঘ দুহাতে মুখ লুকিয়ে বলল, “বলা যাবে না।” “প্লিজ আপু বলো। কে সে?” “আছে কেউ একজন। ”
“পছন্দ করো?” “না। ভালোবাসি” “আপু বলো না প্লিজ।” “খুব শীঘ্রই বলবো। দোয়া কর যেন খুব তাড়াতাড়ি সফল হতে পারি।” “ফি আমানিল্লাহ। ”
আবির রুমে ঢুকে ডিরেক্ট ওয়াশরুমে চলে গেছে। প্রায় ১ ঘন্টা যাবৎ ওয়াশরুমের ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রোধে দু চোখ রক্তাভ হয়ে আছে, মনে হচ্ছে শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে, কপালের দুপাশের রগ দুটা অবিরাম কাঁপছে, মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে গেছে। ঘন্টাখানেক পর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে ভেজা শরীরেই একটা টাওজার আর টিশার্ট পরে নিচে আসছে৷ মেঘ তখনও মীমের কোলে মাথা রেখে খুশগল্পে মেতে আছে। আবিরকে নামতে দেখে মেঘ তৎক্ষনাৎ উঠে বসলো।
আবির নিচে এসে ওদের পাশের সোফায় বসেছে, আবিরকে দেখে মীম নড়েচড়ে বসল। আবির দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। হাতের লোমের গুঁড়ায় এখনও বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। ভেজা চুল গুলো কপাল ঢেকে ভ্রু থেকেও নেমে পরেছে, চুলের আগা থেকে অবিরত মুক্তার মতো পানির বিন্দু আবিরের টিশার্টে পরছে। মেঘ একপলকের জন্য তাকাতেই সর্বাঙ্গে কারেন্টের ন্যায় শক লাগলো, সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে। মেঘ চোখ সরিয়ে নিয়েছে। আবির মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “রুম থেকে আমার ফোনটা নিয়ে আয় ”
কথাটা বলা মাত্র মীম উঠে গেছে৷ মেঘ সোফায় কর্ণারে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। মীম যেতেই মেঘ তাড়াতাড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে কি যেন করতে লাগলো। আবির নিরেট দৃষ্টিতে মেঘের পানে চেয়ে আছে। মেঘ ফোন চাপতে পারছে না, ভয়ে হাত কাঁপছে। আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” তোর কি মনে হচ্ছে না, তুই প্রাপ্ত স্বাধীনতার অপব্যবহার করছিস?” মেঘ চিবুক নামিয়ে চুপচাপ বসে আছে। মেঘের নিস্তব্ধতা আবিরের রাগ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আবির রেগে বলল, “কথা বলছিস না কেন?”
মেঘ কিছু না বলে উঠে যেতে নিলে আবির রাগান্বিত কন্ঠে হুংকার দিল, “আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি মেঘ! কথা কানে যায় না তোর?” মেঘ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল আসছে। ”
বলেই মেঘ কল রিসিভ করে কানে ধরতে ধরতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেছে৷ মেঘের কথাটা আবিরের মনে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। আবির ভ্রু যুগল নাকের গুঁড়ায় টেনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঘের গমনপথে তাকিয়ে রইলো। অকস্মাৎ পাশে রাখা একটা ফুলদানি দেয়ালে একপ্রকার ছুড়ে মারল। শব্দে মেঘের পা সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছে, তবুও তা বুঝতে না দিয়ে রুমের দিকে চলে গেছে। মীম ফোন নিয়ে নিচে আসছে, ফোন আবিরকে দিতে গিয়ে আবিরের রক্তলাল আঁখি যুগল দেখে ভয়ে ঢোক গিলল।
কোনোরকমে ফোন দিয়ে দৌড়ে আম্মুর রুমে চলে গেছে। আবির সেই যে বেড়িয়েছে সারারাতেও বাসায় ফেরে নি । মেঘ অপেক্ষা করতে করতে বেলকনিতেই ঘুমিয়ে পরেছিল। ভোরবেলা হঠাৎ ঘুম ভাঙতে মেঘ থতমত খেয়ে উঠে। তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আবিরের রুমে গেল। আবির রুমে নেই দেখেই মেঘের বুক কেঁপে উঠেছে। ভোর বেলায় বাসার বাহিরের গিয়ে দেখে আসছে আবিরের বাইক আছে কি না! এত সকালে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।আবিরকে কল দেয়ার মতো সাহস ও পাচ্ছে না। সকাল ৭ টা থেকেই মেঘ খাবার টেবিলে বসে আছে, আবির ফিরলে যেন দেখতে পারে৷ কিন্তু আবিরের ফেরার নামগন্ধ নেই৷ সবাই খেতে বসছে, আবির নেই দেখে আলী আহমদ খান প্রশ্ন করলেন,
“আবির কোথায়? উঠে নি?” তানভির গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, “ভাইয়া রাকিব ভাইয়াদের বাসায়। ” “কেন?” “অফিসের কাজে গেছিলো, রাতে আর ফেরে নি।” আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন, “কাজ কাজের জায়গায় থাকবে তার সাথে বাসায় না ফেরার কি সম্পর্ক?”
তানভির আর কিছু বলল না। বড় আব্বুর সাথে যুক্তিতে সে কুলাতে পারবে না তার থেকে কথা না বলায় শ্রেয়। মেঘ নিস্তব্ধ আঁখিতে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মেঘ স্পষ্ট বুঝতে পারছে আবির ভাই তারউপর রাগ করেই বাসা থেকে চলে গেছেন। বাসায় মানুষ যাতে চিন্তা না করে তারজন্য তানভির ভাইয়া কাজের কথা বলেছেন। মেঘ অল্প খেয়ে রেডি হয়ে ভার্সিটিতে চলে গেছে। রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় মেঘের চোখ ঘুমে টলছে। অর্ধ ঘুমে থেকেই ক্লাসগুলো শেষ করেছে। ক্লাস শেষ হতেই বন্যা শুধালো,
“কিরে তুই কি রাতে ঘুমাস নি? চোখ ফুলে আছে কেন?” “ঘুমাইছি, অল্প।” লিজা এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “কিরে বান্ধবী কি অবস্থা? ” “কি অবস্থা হবে?” এরমধ্যে মিনহাজ, তামিম, সাদিয়া, মিষ্টিও আসছে। মেঘ নিরেট কন্ঠে জানালো,
“আমি তোদের কথা আর শুনতে পারবো না।” সাদিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন?” মেঘ ধমকের স্বরে বলল, “আজকে তোদের কথামতো কাজ করতে গিয়ে আমার আবির ভাই বাসা থেকে চলে গেছেন। সারা রাত বাসায় ফিরে নি, আমি বেলকনিতে বসে থাকতে থাকতে ওখানেই ঘুমিয়ে পরেছি। ” বন্যা ধীর কন্ঠে বলল,
” মেঘ তোকে আগেই সাবধান করেছি। তুই আমার কথা কানেই তুলছিস না। আবির ভাইকে তুই চিনিস না? ওরা নাচতাছে আর তুই ও তাতে তাল দিচ্ছিস! এখনও সময় আছে এসব বাদ দে। ওনি মনের ভাব প্রকাশ করতে না চাইলে শুধু শুধু ওনাকে জোর করিস না, প্লিজ। পরে দেখবি ভালোর বদলে উল্টো খারাপ হবে। ” মেঘ কিছু বলার আগে মিনহাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এই বন্যা, তুই থামবি। মেঘ তুই একদম ঠিকঠাক রাস্তায় যাচ্ছিস। বন্যার কথায় কান দিস না। ওনি যদি তোকে পছন্দ করে তাহলে ওনি প্রকাশ করবে আর পছন্দ না করলে ডিরেক্ট চাপ্টার ক্লোজ। এভাবে ঝুলে থাকার কোনো মানে হয় না বুঝলি! ”
সাদিয়াও সঙ্গে তাল দিল, “হ্যাঁ সত্যিই তো। মেঘ ওনাকে এত পছন্দ করে ওনি কি এসব বুঝে না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভাব নেয়। সবটা ক্লিয়ার করা প্রয়োজন। ওনার মনে কি চলে তা জানলে মেঘ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।” বন্যা ভরা গলায় বলল, ” তোরা বুঝার চেষ্টা কর, মেঘ তোদের মতো এত বুঝদার আর স্ট্রং না। উল্টাপাল্টা আচরণ করলে আবির ভাই মেঘকে মে*রেই ফেলবে।” মিনহাজ রাগী স্বরে বলল, “কোন অধিকারে মারবে? কার এত সাহস যে মেঘের গায়ে হাত তুলবে ।মেঘ তোকে কিছু বললে তুই শুধু আমায় বলবি, বুঝলি।” বন্যা উপহাসের স্বরে বলল,
” তোকে দাপট দেখাতে আগেই নিষেধ করেছিলাম। তুই আবির ভাইয়া সম্পর্কে জানিস না তাই দয়া করে চুপ থাক। মেঘ তুই তো ওনাকে চিনিস৷ প্লিজ আমার কথা মান, ওদের কথামতো এমন কাজ করিস না প্লিজ। ” মেঘ নিরুপায় হয়ে সবার দিকে তাকালো। একদিকে বন্যা বারণ করছে। অন্যদিকে বাকি সবাই বলছে মেঘ যা করছে একদম ঠিক করছে। অন্যদিকে আবির ভাই রাগে বাসা থেকে চলে গেছেন৷ মেঘ এখন কি করবে! মিনহাজ ফটাফট বলা শুরু করল,
“দেখ মেঘ, ওনি তোর আচরণে রেগে বাসা থেকে চলে গেছে মানে ওনার মনে কিছু একটা আছে। এখন সেটা আমাদের প্রকাশ করাতে হবে। মাঝপথে ছেড়ে দিলে তুই জীবনেও তোর কাঙ্ক্ষিত কথা জানতে পারবি না। এখন তুই ভাব, বন্যার কথা মেনে এভাবেই চলবি নাকি আমাদের কথা মেনে তোর আবির ভাইয়ের মনের কথা শুনবি৷ ” মেঘ বোকার মতো তাকিয়ে আছে। লিজা পুনরায় বলল,
“তোর প্রেম রোগের বছর হয়ে যাচ্ছে। আর কতদিন ওনার পিছুপিছু ঘুরবি বলতো? ওনি ভালো না বাসলে ওনার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে অন্য কারো সাথে সম্পর্কে যাবি। প্রয়োজনে ছেলে আমরা ঠিক করে দিব তবুও ওনার মোহে এভাবে পরে থাকিস না।”
প্রায় ১ ঘন্টা সবাই মিলে মেঘকে জ্ঞান দিয়েছে৷ বন্যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডিরেক্ট না। মেঘ যাতে এমন কাজ কোনোভাবেই না করে। অথচ মেঘ বাকিদের কথা শুনে রাজি হয়ে গেছে। বন্যা যেতে যেতে আরও কিছুক্ষণ মেঘকে বুঝালো কিন্তু মেঘের মাথায় কিছুই ঢুকলো না। মেঘের মনে- মস্তিষ্কে শুধু একটায় চিন্তা, আবির ভাইয়ের মুখে “ভালোবাসি” শব্দটা শুনা সেটা যেকোনো মূল্যেই হোক। মেঘরা চলে যেতেই তামিম মিনহাজকে প্রশ্ন করল, “তোর মনে কি চলছে বল তো!” মিনহাজ উল্টো প্রশ্ন করল,
“কেন?” “তুই মেঘকে উস্কাচ্ছিস যাতে আবির ভাইয়ার মনের ভাব জানতে পারে। কাহিনী কি?” মিনহাজ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আমি মেঘকে পছন্দ করি, ওর প্রতি বেধক অনুভূতিও আছে কিন্তু ওর মনে আমার জন্য বিন্দুমাত্র কিছু নেই। ওর মস্তিষ্কে আবির ভাইয়া ছাড়া কিছুই নেই। এ অবস্থায় আমি যত চেষ্টায় করি ওর মনে আমার জায়গা করতে পারবো না। দেখলি তো আবির ভাইয়া আমায় ব্লক দিয়েছে এই খুশিতে সেদিন সবাইকে চকলেট দিল। এমতাবস্থায় আমি কোনোকিছু আশায় করতে পারি না।”
তামিম বিস্ময় সমেত তাকিয়ে বলল, “তাহলে তুই তোর অনূভুতি কোরবান করে মেঘকে আবির ভাইয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাচ্ছিস?” মিনহাজ রাশভারি কন্ঠে পুনরায় বলল, “হতে পারে তাই আবার উল্টোটাও হতে পারে। ” “যেমন?” মিনহাজ লম্বা করে শ্বাস টেনে বলা শুরু করল,
“দেখ, মেঘ প্রায় ৯ মাস যাবৎ আবির ভাইয়াকে পছন্দ করে। আমাদের সাথে ওর বন্ধুত্ব প্রায় ৪-৫ মাসের। তারমানে আমাদের সাথে পরিচয়ের আরও ৪-৫ মাস আগে থেকে মেঘ ওনাকে পছন্দ করে। মেঘ যথেষ্ট কিউট আর লক্ষী একটা মেয়ে৷ যে কেউ এক দেখায় ওর প্রেমে পরবে। সেখানে ওনি তো এক বাড়িতে থাকেন। এই ৯ মাসেও কি ওনি মেঘকে খেয়াল করেন নি? অবশ্যই করেছেন এবং মেঘের অনুভূতিও বুঝেছেন। তবে প্রকাশ করছেন না! কেনো? হতে পারে ওনার জীবনে অন্য কেউ আছে। ওনি তার সাথে কমিটেড আবার মেঘের প্রতিও ওনার সফ্ট কর্নার আছে। এজন্য আমি মেঘের মাধ্যমে আবির ভাইয়াকে উস্কাচ্ছি। এই সুযোগে মেঘের সাথে আমার রেগুলার কথা হচ্ছে এবং সম্পর্ক গাঢ় হচ্ছে। বাই চান্স আবির ভাই রেগে মেঘের উপর রিয়েক্ট করলে মেঘ আমাকেই বলতে আসবে। তখন আমি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমার দিকে আকৃষ্ট করবো।”
তামিম শুকনো ঢোক গিলে বলল, “ভাবতে অবাক লাগছে তুই আমার বন্ধু! এত চিকন বুদ্ধি নিয়ে ঘুমাস কিভাবে? ” মিনহাজ খিকখিক করে হেসে উঠলো, হাসতে হাসতে বলল, “তুই ই বলছিলি ওনারা ইচ্ছেকৃত ওনাদের অবস্থান বুঝাতে আমাদের মেঘের বার্থডে তে ডেকেছিল। আবির ভাইয়া প্ল্যান করতে পারলে আমি কেন পারব না ” “আর যদি আবির ভাই মেঘকে ভালোবাসি বলে দেন। তখন কি করবি?” “তখন মেঘের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবো। তবুও বিষয়টার সমাধান হওয়া দরকার। ”
সপ্তাহ কেটে যাচ্ছে অথচ মেঘের ব্যবহার অপরিবর্তিত। আবিরকে এড়িয়ে চলা, আবির কে দেখিয়ে দেখিয়ে ফোনে কথা বলা, ইচ্ছেকৃত খোঁচানো সবই চালাচ্ছে। আবির দু একবার মেঘের সঙ্গে কথাও বলতে চেয়েছে কিন্তু মেঘের ব্যস্ততা আর পাত্তা না দেয়ায় আবির আর কিছু বলে নি। মেঘকে মেঘের মতোই ছেড়ে দিয়েছে।
তানভির আজ এমপির সাথে একটা পোগ্রামে ব্যস্ত। সকালে না খেয়ে বেড়িয়েছিল। আবির দুপুর পর্যন্ত আব্বুর অফিসের কাজ শেষ করে বিকেলে নিজের অফিসে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে, সকালে থাকতে পারবে না বলে মিটিং বিকেলে রেখেছিল। ইদানীং মেঘের উড়নচণ্ডী চলাচলে আবিরের মনের সাথে সাথে কাজেও তার প্রভাব পরছে। মিটিং গত সপ্তাহে হওয়ার কথা ছিল আবির সেটা পেছাতে পেছাতে আজ পর্যন্ত টেনে এনেছে। আব্বু চাচ্চুর সামনে স্ট্রং ভাবে কাজ করলেও নিজের অফিসে এসেই সম্পূর্ণ ভেঙে পরে। আজ নিজেকে শক্ত রাখতে ফোন বন্ধ করে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে।
নিজের রুম ছেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে রাকিবের রুমে কাজ করছে৷ রাসেল দুপুর পর্যন্ত অফিস করেছে। আজ তার গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিন তাই দুপুরের দিকে চলে গেছে। প্রায় ২ ঘন্টা আবিরদের মিটিং চলল। মিটিং শেষে রাকিব বের হতে হতে পকেটে থেকে ফোন বের করতেই দেখলো রাসেল ১০ বার কল দিয়েছে। রাকিব কল ব্যাক করতেই রাসেল আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“ঐ আবির কই। আবির কে তাড়াতাড়ি নেটে আসতে বল। ” “কেন কি হয়ছে। ” “তুই আবিরকে বল” বলেই রাসেল কল কেটে দিয়েছে। রাকিব আবিরকে বলা মাত্র আবির রুমে গিয়ে ফোন খুলে নেটে ঢুকতেই রাসেলের মেসেজ আসছে সাথে ছবিও । ছবিতে চাপ দিতেই দেখল, মিনহাজ বেশকয়েকটা লাল গোলাপ হাতে হাঁটু গেড়ে বসে মেঘের সামনে ফুল ধরে রেখেছে। মেঘ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। বন্যা, মিষ্টি, সাদিয়া, লিজা, তামিম সবাই পাশে দাঁড়ানো। ছবি টা দেখা মাত্র আবির ধপ করে চেয়ারে বসে পরেছে। রাকিব ক্লাইন্ডদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। আবির কয়েক মুহুর্তের মধ্যে বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাকিব পেছন থেকে ডেকে বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস?” আবির উত্তর না দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। রাসেলকে কল দিয়ে জায়গা টা জেনে দ্রুত পৌঁছালো সেখানে। মেঘদের কাছাকাছি গিয়ে বাইকের ব্রেক কষল। মেঘরা সবাই গোল মিটিং করে বসে চা খাচ্ছিলো। মিনহাজের হাতে এখনও একগুচ্ছ লাল গোলাপ। রাসেল আর তার গার্লফ্রেন্ড কিছুটা দূরেই বসে ছিল। আবির মেঘদের কাছে আসতেই সবাই মাথা উঁচু তাকালো। চায়ের কাপ সাইডে রেখে সবাই একসঙ্গে দাঁড়ালো। মেঘ আবিরের শ্যামবর্ণের চেহারার পানে চেয়ে আছে, সহসা হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে সাথে মনের ভেতরের খুঁচখুঁচ লেগেই আছে। আবির চোখ বুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দু কদম এগিয়ে মেঘের ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেঘ কিয়ৎক্ষণ আহাম্মকের মতো চেয়েই রইলো কিছুই বললো না। আবির প্রখর নেত্রে মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“এখানে কেন আসছিস?” মেঘের অনিচ্ছা সত্বেও ঠোঁটে মিষ্টি হাসি রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “আড্ডা দিতে।” আবির পুনরায় প্রশ্ন করল, “শুধুই আড্ডা দিতে?” “জ্বি” মেঘের কন্ঠস্বরে নিরুত্তাপ ভাব দেখে আবিরের মেজাজ চরম লেবেলের খারাপ হচ্ছে। বার বার চোখে সেই ছবিটা ভাসছে। আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “সত্যি কথা বল মেঘ। ” মেঘ নিরুত্তর। মিনহাজ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “ভাইয়া, মেঘ কিছু বলবেন না”
আবির ঘাড় ফিরিয়ে রক্তাভ চোখে তাকালো মিনহাজের দিকে। কন্ঠে অগ্নি ঢেলে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, ” Stop your mouth. আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এখানে আসি নি। আজ আমার আর মেঘের মাঝে কেউ একটা টু শব্দ করলে তার লা*শ পরবে এখানে।” আবিরের লাল চোঁখ জোড়া দেখে মিনহাজ দৃষ্টি নামিয়ে নিল। বন্যাসহ সবাই মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আবিরের হুঙ্কারে ভয়ে সবকটা কাঁপছে। ওদের অবস্থা দেখে আবির নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিন্তু ভেতরের ক্রোধের কাছে হার মানতো বাধ্য হলো। আবিরের এমন কান্ডে মেঘ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট, বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা দিগবিদিক ছুটছে, ভয়ে ঢোক গিলল। আবির মেঘের চোখে চোখ রেখে কন্ঠ চারগুণ ভারী করে শুধালো,
“তুই ঐ ছেলেকে পছন্দ করিস? হ্যাঁ কি না?” মেঘ নিরেট দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। বার বার ঢোক গিলছে। কিছু বলতে পারছে না। মেঘ সহসা তাকালো ওদের দিকে। মিষ্টিরা চোখে ইশারা দিয়ে হ্যাঁ বলতে বলল। আবির ভাইয়ের মনের কথা জানার এর চেয়ে উত্তম উপায় আর নেই। মেঘের শ্বাস আঁটকে যাচ্ছে। শ্বাসনালীতে তুফান চলছে। কি করে বলবে এত বড় মিথ্যাটা৷ আবির মেঘের বাহুতে চেপে ধরে বাজখাঁই কন্ঠে চিৎকার করল, “তাকা এদিকে।”
মেঘের দেহ আবারও কম্পিত হলো সঙ্গে সঙ্গে তাকালো আবিরের চোখের দিকে। রক্তাভ দু চোখ থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে, সেই আগুনের মেঘের হৃদয় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মিনহাজদের শেখানো প্রতিটা কথা মেঘের মাথায় ঘুরছে। আবির ভাইয়ের মনের কথা জানতে হলে মিথ্যাটা বলতেই হবে। মেঘ ঢোক গিলে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ”
আবির সহসা মেঘের বাহু ছেড়ে দিয়েছে। কয়েক মুহুর্ত মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কপাল ঘামছে, আবির হাত দিয়ে কপালোর ঘাম মুছে ঘুরে গিয়ে বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দিল। রাসেল আবিরকে থামানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু আবির বাইক থামানোর অবস্থায় নেই। আবির চলে গেছে, মেঘ অকস্মাৎ মাথা ঘুরে পরতে নিলে বন্যা তাড়াতাড়ি মেঘ কে জড়িয়ে ধরে। আবিরের সামনে মেঘ যতই শক্ত কন্ঠে কথা বলুক না কেন ভেতরের কম্পনের কাছে সব হার মানতে বাধ্য। মেঘ অজ্ঞান হয়ে বন্যার কোলে শুয়ে আছে। মিষ্টিরা পানি এনে মেঘের চোখেমুখে পানি ছেটাচ্ছে। এরমধ্যে রাকিব আসছে, আবির কল না ধরায় রাকিব রাসেলকে কল দিয়েছিল রাসেল সবটা বলাতে রাকিব সঙ্গে সঙ্গে অফিস ছুটি দিয়ে রওনা দিয়েছে। তানভিরকেও সব জানিয়েছে। রাকিব বাইক থাকিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে শুধালো,
“আবির কোথায়?” “আবির চলে গেছে।” “কোথায়?” “জানি না।” রাকিব উদ্বিগ্ন কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, “তুই ওকে আটকাতে পারলি না।” “ও কি আমার কথা শুনার মানুষ? চেষ্টা তো করেছি ” ওদের কথোপকথনের মধ্যেই তানভির বাইক থেকে নেমে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “ভাইয়া কোথায়?” রাকিব মৃদু স্বরে বলল “ও বাইক নিয়ে চলে গেছে। ”
তানভির আগপাছ না ভেবে মিনহাজকে এলোপাতাড়ি মাইর শুরু করলো। তামিম বাঁচাতে আসলে তামিমের গায়েও বেশ কিছু মাইর পরেছে। রাকিব, রাসেল তাড়াতাড়ি গিয়ে তানভিরকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে আনলো। দুজনে মিলেও তানভির কে আঁটকে রাখতে পারছে না। মাইরের চুটে মিনহাজের হাতের ফুলগুলো মাটিতে পরে গেছে। মিনহাজের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রাকিব আর রাসেল তানভিরকে শান্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তুই মেঘকে নিয়ে বাসায় যা।
তানভির মেঘকে ধমক দিতে গেলে রাকিব সঙ্গে সঙ্গে ভারী কন্ঠে বলল, “তানভির, মেঘকে কিছু বলবি না।চুপচাপ বাসায় নিয়ে যা।” তানভির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বন্যার দিকে একপলক তাকালো। রাগ আর ক্রোধ যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। ঘুরে যেতে নিলে ফুলগুলোর দিকে তানভিরের নজর পরে। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের জুতা দিয়ে টকটকে গাল গোলাপ গুলো পিষে ফেলেছে। মিষ্টিরা চোখ নামিয়ে সেই দৃশ্য দেখলো। কেউ চোখ তুলে তানভিরের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না কেউ। তানভির বাইকের কাছে যেতে যেতে মিনহাজদের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল,
” আমি এখন চলে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমার ভাইয়ের কিছু হলে তোদের খবর আছে বলে দিলাম।” তানভির বাইকে স্টার্ট দিয়ে মেঘকে উদ্দেশ্য করে ভারী কন্ঠে বলল, “উঠ।” রাকিব আবারও বলল,
“মেঘকে চুপচাপ বাসায় নামাইয়া দিবি। রাগ দেখাবি না বললাম।” তানভির মিনহাজদের দিকে একবার তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে রাকিববের উপর চেঁচিয়ে উঠল, “আমার ভাইকে তাড়াতাড়ি খোঁজে বের করো। না হয় লা*শ ঘোম করার ব্যবস্থা করো। আমি আসছি।”