সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | নিয়তির খেলা

৪৭ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

মেঘের ঘুম ভাঙতেই দেখল, ফুপ্পির নাম্বার থেকে দুটা কল, আরিফ আর জান্নাত আপুর নাম্বার থেকেও বেশ কয়েকটা কল আসছে সেই সাথে আবিরের নাম্বার থেকে প্রায় দুই ঘন্টা আগে ৩ বার কল আসছিল। আবিরের নাম্বার টা চোখে ভাসতেই মেঘের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল, কানে বাজছে দুপুরে খাবার টেবিলের কথাগুলো সেই সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বড় আব্বুর পায়ে ধরে ফুপ্পিদের কান্নার দৃশ্য।

মেঘ শুয়ে রুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে আর হাবিজাবি ভাবছে, বেশ কিছুক্ষণ পর শুয়া অবস্থায় ফুপ্পিকে কল দিলো। ফুপ্পির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল, মনের অবস্থা ভালো না বলে বেশি কথাও বললো না। আরও ঘন্টাখানেক চুপচাপ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো৷ কি ভাবছে, কেন ভাবছে তার সবটায় অজানা৷ এরমধ্যে দুএকবার রুম থেকে বেড়িয়ে বেলকনি পর্যন্ত গিয়েওছে৷ কিন্তু বাড়ির পরিবেশ বেশ নিরব, কেউ কোথাও নেই, প্রতিদিনের মতোই ড্রয়িংরুম শুধু একটা বাল্ব জ্বলছে। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে আবিরকে দেখতে যাওয়ার সাহস ছোট্ট মেঘের হচ্ছে না৷ তাই দুবার ই রুমে ফিরে আসছে৷ আবিরের নাম্বারে একবার কলও দিয়েছিল, আবির কল রিসিভ করে নি৷ প্রায় ঘন্টাখানেক রুমে পায়চারি করার পর অবশেষে মেঘ বুকে সাহস নিয়ে আবিরের রুমের দিকে পা বাড়ালো।


মেঘ উপরে থাকাকালীন এতবছরে আজ অবধি ভয়ে রাতের বেলা নিচে নামে নি। পানি সহ প্রয়োজনীয় সব জিনিস সন্ধ্যের আগেই রুমে নিয়ে আসে। আবিরকে দেখার জন্য মেঘ এত রাতে ভয়ে ভয়ে নিচে নামছে৷ রুমের দরজা ধাক্কা দিতেই মৃদু আলোতে আবিরের ঘুমন্ত ধৃষ্টতা ভেসে উঠল। মেঘ ধীর গতিতে রুমে প্রবেশ করল। নিস্তব্ধ আঁখিতে বেশকিছু সময় আবিরকে পরখ করল। বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে আবিরের চুল গুলো উড়ছে, গাল ভর্তি দাঁড়ি গুলো অনেকটায় বড় হয়ে গেছে সেই সাথে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে শ্যামবর্ণের চেহারা তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে৷ মেঘ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আচমকা বিছানার পাশে ধপ করে ফ্লোরে বসে পরলো।

মাঝরাতে নিস্তব্ধ পরিবেশে বাসার পাশে গাছের ঢালে দুটা পাখির কিচিরমিচির শব্দ ব্যতীত আর কোনো শব্দ নেই৷ অকস্মাৎ আবিরের ঘুম ভেঙে গেছে, অনুভব করে একজোড়া তুলতুলে হাত আবিরের একহাত আঁকড়ে ধরে রেখেছে, আবিরের হাতের আঙুল গুলো কোমল গাল স্পর্শ করে রেখেছে৷ আবিরের অনুভূতিরা জানান দিচ্ছে আবিরের প্রেয়সী আবিরের হাতকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে।

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু মেঘের হঠাৎ কান্না সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে৷ প্রথম দিকে আস্তেধীরে কাঁদলেও ধীরে ধীরে মেঘ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। মেঘের নিরবচ্ছিন্ন কান্নায় চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরা পানিতে মেঘের গালে রাখা আবিরের আঙুল গুলো ভিজে গেছে৷ মেঘের কান্নার শব্দে আবিরের বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে। মাঝরাতে মেঘ কেন কাঁদছে, কেউ কিছু বললো কি না, আগে আবিরের কল কেন রিসিভ করল না সেসব ভেবে আবির অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এদিকে মেঘের কান্না থামার কোনো নাম নেই৷ মেঘের হাতে থাকা আবিরের আঙুল গুলো তিরতির করে কাঁপছে, মেঘ কান্নার জন্য তা বুঝতেই পারছে না। আবির কাতর স্বরে মনে মনে বলল,

” মেঘ, তুই এভাবে কাঁদিস না প্লিজ। তোকে কিভাবে বুঝায়, তুই কাঁদলে যে আমার ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যায়৷ তুই জানিস না, তোর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি ঝড়লে এই আবিরের হৃদয় থেকে কত ফোঁটা র- ক্ত ঝড়ে৷ তোর কান্না দেখলে খু-* ন না করেও নিজেকে খু*-নী মনে হয়। তোর কাছে থেকেও আজ আমি বহুদূরে, তোকে ছোঁয়ার অধিকার থাকা সত্ত্বেও আজ আমি বড্ড অসহায়। ”

মেঘ আপনমনে কেঁদেই চলেছে, মাঝরাতে আবির মেঘকে কি বলবে, মেঘকে ডাকলে মেঘ অস্বস্তিতে পরে যাবে। সেসব ভেবেই আবির মেঘকে ডাকার সাহস পাচ্ছে না। মেঘ কাঁদতে কাঁদতে আবিরের হাতে অধর ছুঁয়ে দিচ্ছে, পুনরায় গালে হাত চেপে ধরে ব্যগ্র কন্ঠে বলল,

” আবির ভাই, আপনি আমার প্রাণচঁচল্যের একমাত্র শখের পুরুষ, আমার হৃদয়ের একান্ত ব্যাকুলতা। চিত্তচাঁচল্য নয় বরং আমি আপনার প্রণয়ের পরিণীতা হতে চাই৷” মেঘের কান্না জড়িত কন্ঠে বলা একেকটা কথা শুনে আবিরের হৃদস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ইচ্ছে করছে সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে কাদম্বিনীর দুচোখের পানি মুখে, মায়াবী দুচোখে চোখ রেখে অনুরক্ত কন্ঠে বলতে, “মাহদিবা খান মেঘ, আপনিও আমার অস্তিত্বে নিবদ্ধ একমাত্র শখের নারী, আমার আত্মাকে প্রশান্ত করার অনন্য পন্থা। পৃথিবীর সব নারীকে অবহেলা করতে পারলেও মাহদিবাকে উপেক্ষা করার সাধ্যি এই আবিরের নেই। চিন্তা নেই ললনা, আপনি আমার প্রণয়ের একমাত্র পরিণীতা হবেন, শুধু সময়ের প্রতীক্ষা। ”

মেঘ অতর্কিতে আবিরের হাত ছেড়ে নিস্তরজ আঁখিতে আবিরকে আপাদমস্তক পরখ করে, নিসাড় মাথা নিচু করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আবির অক্রুর দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে,চোখে উপচে পড়ছে প্রশান্তি। মেঘ অতি সন্তর্পণে হাঁটছে যেন কারো নজরে না পরে। ড্রয়িং রুম পার হয়ে দুটা সিঁড়ি উঠতেই পাশ থেকে ভারী পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে আসলো, “এত রাতে নিচে কি করছিস?”

মেঘ আঁতকে উঠে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল ইকবাল খান সোফার পাশে দাঁড়ানো৷ ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি করে মেঘ জামার উপর দিয়েই বুকে থু থু দিল। দাঁত দিয়ে জিভ কেটে, চোখ নামিয়ে মেঘ ধীরস্থির কন্ঠে আমতা আমতা করে বলল, ” পা. পানি খেতে আসছিলাম।” ইকবাল খান গুরুভার কন্ঠে বললেন, ” অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে যা এখন।”

মেঘ ঘাড় কাত করে “আচ্ছা” বলে গুটিগুটি পায়ে উপরে উঠে গেছে। সময় চলমান৷ মেঘ নিজের মতো ভার্সিটিতে যায়, বন্যার সাথে টুকিটাকি কথা বললেও মিনহাজ, তামিম, মিষ্টি কারো সঙ্গেই তেমন কথা বলে না,ওদের দেখলেই এড়িয়ে যায়৷ নিজের প্রতি তীব্র ক্ষোভ থেকেই মূলত মেঘের এই কাজ করা। তানভিরও নিজের কাজে ব্যস্ত, বাসায় ফিরে আবিরের সাথে টুকটাক কথা বলে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমায়। দেখতে দেখতে ২১ দিন পেরিয়ে গেছে, আবিরের পা অনেকটায় ঠিক হয়ে গেছে৷ মোটামুটি হাঁটা চলাও করতে পারে৷ এরমধ্যে একদিন সন্ধ্যের দিকে সাকিল সাহেব আলী আহমদ খানকে কল ও দিয়েছেন। আবিরের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য, তাছাড়া ওনারা খুব শীঘ্রই আবিরকে দেখতে আসতে চাচ্ছেন। কিন্তু আবিরের রাগ দেখে আলী আহমদ খান ডিরেক্ট নিষেধ করে দিয়েছেন। আবির কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরেই নিজের রুমে চলে আসছে। এত দিনের মধ্যে মেঘ আবিরকে দেখতে যতবারই আবিরের রুমে যায় ততবার ই মীম মেঘকে নিয়ে মজা করে, মীমের দুষ্টামির জন্য এখন, আবির রুমে একা থাকলে মেঘ লজ্জায় রুমেই যায় না।

অনেকদিন ধরে ছাদে যাওয়া হয় না, গাছ গুলোর তেমন যত্নও নেয়া হয় না। মীম আর আদি মাঝে মাঝে গাছগুলোতে পানি দেয়। আজ বিকেলের দিকে মেঘ আর মীম ছাদে গেছে, গাছগুলোর আগাছা পরিষ্কার করছে আর দু বোন নিজেদের মতো গল্প করছে৷ মীম মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” আপু সামনে ঈদ, তুমি ভাইয়াকে কিছু দিবা না?” “একটা পাঞ্জাবিতে হ্যান্ডপ্রিন্ট করে দিব ভাবছিলাম। ”

“এটা তো খুব ভালো আইডিয়া৷ ডিজাইনের মাঝে তোমার নামটাও লিখে দিও৷ ” “নাহ নাহ। এসব করা যাবে না। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে৷ ” “তোমাকে বড় করে লিখতে বলছে কে? একদম ছোট ছোট অক্ষরে লিখবা। মানুষ কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে নাকি?” “আমার ভয় লাগে। আবির ভাই দেখলে খুব বকা দিবেন।” “কে বকা দিবে? ভাইয়া?” “হ্যাঁ”

“ভাইয়া দিবে তোমাকে বকা? এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? শুনো আপু, আর যাই বলো আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নিবো৷ কিন্তু ভাইয়া তোমাকে বকবে এটা আমি জীবনেও বিশ্বাস করব না। ” মেঘ মুখ গোমড়া করে বলল, “সত্যি ই ওনি আমাকে বকা দেন। ” “তুমি হয়তো খেয়াল করো না তবে আমি খেয়াল করেছি, বাসার মধ্যে ভাইয়া একমাত্র তোমার সাথে কথা বলার সময় ই মাধুর্য মিশিয়ে মনোরম কন্ঠে কথা বলে, তোমাকে দেখলেই ভাইয়ার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। ” “বলছে তোরে! ”

“আল্লাহ! বিশ্বাস করো না? তুমি আমাকে ভাইয়ার কথা বলছো পর থেকে আমি বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করেছি৷ তোমার প্রতি ভাইয়ার অন্য লেবেলের টান আছে। ভাইয়াকে কিছু আনতে বললে ভাইয়া যতই ব্যস্ত থাকুক, তোমার কথা শুনা মাত্রই সব ব্যস্ততা সাইডে রেখে সাথে সাথে নিয়ে আসে৷” মেঘ কপাল কুঁচকিয়ে বলল, “ভাবের কথা বাদ দে৷ ”

“আমার ভাইয়ার এত কেয়ার তোমার কাছে ভাব মনে হয়? এমন করলে তোমাকে আমার ভাইয়ার বউ বানাবো না বলে দিলাম।” “আর বউ! বাসার আর আবির ভাইয়ের যে অবস্থা, আমার ভালোবাসা কোনোদিন পূর্ণতা পাবে বলে মনে হয় না!” “বললেই হলো। সত্যিকারে ভালোবাসা থাকলে পূর্ণতা পাবেই, ইনশাআল্লাহ। এখন তোমাকে যা বলছি তা করো, ঈদে ভাইয়াকে একটা পাঞ্জাবি গিফট সেটাতে অবশ্যই তোমার নাম থাকতে হবে। আগে আমাকে দেখিয়ে নিবা, বুঝছো? ”

“বুঝছি। কিন্তু পাঞ্জাবি কিনতে হবে তো, পাঞ্জাবির সাইজ জানি না তাছাড়া পাঞ্জাবি কিনবো কিভাবে? “ভাইয়াকে দেখেছিলাম নিচে গেছে, তুমি এখন ভাইয়ার রুমে যাও, ভাইয়ার পাঞ্জাবি থেকে সাইজ টা দেখে আসো, আমি বাহিরে পাহারা দিব। ভাইয়া আসলেই তোমাকে ডাকবো। পরে আম্মুকে নিয়ে শপিং এ গিয়ে পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে আসবো।”

“আচ্ছা, চল।” আবির নিচে সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর ল্যাপটপে কাজ করছে, ইকবাল খান পাশের সোফায় বসে আবিরের সাথে অফিসের বিভিন্ন টপিক নিয়ে কথা বলছেন। মীম বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আবিরের দিকে নজর রাখছে, মেঘ আবিরের রুমে ঢুকে ওয়ারড্রবে পাঞ্জাবি খোঁজছে৷ আবির কাজের ফাঁকে হঠাৎ উপরে হালকা তাকাতেই মীম থতমত খেয়ে পেছনে সরে গেছে। মীমের এমন কান্ডে আবির কপাল কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। কিছু একটা ভেবেই আবির বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ইকবাল খান স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

“কোথায় যাচ্ছিস?” “আসছি একটু।” “তাড়াতাড়ি আসিস, কাজ শেষ করতে হবে।” “হ্যাঁ হ্যাঁ আসছি এখনি ” আবির তড়িঘড়ি করে উপরে উঠছে৷ আবিরের ভয়ে মীম আর নিচে দেখতেই পারে নি। আচমকা আবিরকে বেলকনিতে দেখে মীম আঁতকে উঠল। গলা থেকে কোনো কথায় বের হচ্ছে না, মেঘকে ডাকতেও পারছে না। আবির বড় বড় কদম এগিয়ে এসে ভারী কন্ঠে শুধালো,

“এখানে কি করছিস?” মীম এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে বুঝালো,”কিছু না” আবির ফের বলে উঠল, ” যা এখান থেকে। ” মীম বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে, আবিরের তপ্ত দৃষ্টির ভয়ে মেঘকে আর ডাকতে পারছে না। আবির পুনরায় বলল, “কি হলো?”

মীম মাথা নিচু করে দৌড়ে চলে গেছে। আবির রুমের দরজা চাপিয়ে নিচে গিয়েছিল, এখন দরজা কিছুটা খোলা দেখেই অনুমান করতে পারছে রুমে কেউ আছে। আবির দরজা থেকে রুমে চোখ বুলালো। হঠাৎ আবিরের নজর স্থির হলো, মেঘ আবিরের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আবির ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেল সেদিকে। বেলকনিতে আবির আর মীমের কথোপকথন শুনেই মেঘ তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি লুকিয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে বারান্দায় চলে গেছে। আবির গুরুতর কন্ঠে শুধালো,

” আমার রুমে কি করছিস?” মেঘ নিশ্চুপ থেকেই আবিরের পাশ কেটে চলে যেতে নিল। আবির আবারও প্রশ্ন করল, ” আমার রুমে কেন আসছিলি? তাও আবার পাহারাদার রেখে?” মেঘ ভয়ে ঢোক গিলে ধীর কন্ঠে বলল, “এমনি আসছিলাম। ” মেঘ চলে যেতে নিলেই আবির মেঘের হাত চেপে ধরে। মেঘ আতঙ্কিত নয়নে তাকিয়ে বলল, “ছাড়ুন, যাবো।”

” রুমে কেন আসছিলি সেটা বল,তাহলে ছেড়ে দিবো।” মেঘ আমতা আমতা করে বলল, “আপনারা রুমে আসা কি নিষেধ? ” “নিষেধ কেন হবে, তোর যখন ইচ্ছে রুমে আসবি কিন্তু পাহারাদার কেন বাহিরে থাকবে? কি করতে আসছিলি বল” “চুরি করতে আসছিলাম, হয়েছে!” আবির অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ” আর কি চুরি করার বাকি আছে?” “মানে?”

আবির মেঘের হাত ছেড়ে মুচকি হেসে বলল, ” আমার রুমে কি এমন জিনিস আছে যা তোর চুরি করে নিতে হয়, তোর কি লাগবে নিয়ে যা। ” মেঘ মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, “সম্পূর্ণ আপনি টা কেই আমার লাগবে, কিভাবে নিব বলুন।” আবির কিঞ্চিৎ হেসে বলল, ” কি হলো? কিছু খোঁজে পাচ্ছিস না?”

মেঘ কপাল গুটিয়ে রিনিঝিনি হেসে আবিরের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, ” আমি যা নিতে চাই তা আপনাকে দেখিয়ে নিতে পারবো না৷ ” আবির চোখ বড় করে সম্পূর্ণ রুমে নজর বুলিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ” তাহলে কি আমি ঘুমালে নিতে পারবি?”

মেঘ ছোট করে ভেংচি কেটে বিড়বিড় করতে করতে চলে যাচ্ছে, আবির ঠোঁট কামড়ে হাসছে। মেঘ দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। কয়েক পা পিছিয়ে দরজার পাশে দেয়ালে তাকালো। দেয়ালে একটা হাতের ছাপ দেখে মেঘের নজর স্থির হলো, সরু নেত্রে খেয়াল করল, হঠাৎ মনে পরে গেল প্রায় ২-৩ মাস আগে রুমে রঙ করার ঘটনা। ভেজা রঙে মেঘের হাতের ছাপ পরেছিল, সেই ছাপ শুকিয়েছে বহুদিন আগেই৷ দরজার আড়ালে ছিল বলে আজ পর্যন্ত মেঘের চোখে পরে নি। আজ দরজাটা চাপানো ছিল বিধায় মেঘের নজর আটকেছে। মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

” এই দাগ টাতে রঙ করান নি কেন?” মেঘের কন্ঠে আবির পেছন ফিরে তাকিয়েছে, মেঘের দৃষ্টি খেয়াল করে নিজেও সেদিকে তাকালো। আবির মুখের ভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে বলল, ” লোকের কি খেয়ে কাজ নেই, তুই নষ্ট করবি আর তারা বার বার রং করবে!” “বার বার করবে কেন? একবার ই তো নষ্ট করেছি তাও পরে গেছিলাম বলে ।” আবির উদাসীন কন্ঠে বলল,

” বেরঙিন জীবনে রুমে রঙ করে আর কি হবে?” মেঘ প্রখর নেত্রে আবিরের দিকে তাকিয়ে অকস্মাৎ বলে উঠল, ” আমার কাছে রঙ আছে, আমি এখনি নিয়ে আসছি। হাতের ছাপ মুছে সুন্দর ডিজাইন করে দিব। ” আবির বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল, ” যেভাবে রুমে আসছিলি সেভাবে বেড়িয়ে যা, আমার রুম যেমন আছে তেমনই থাকবে, মাতবরি করে নষ্ট করতে হবে না ”

মেঘ কন্ঠ খাদে নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “বিশ্বাস করুন নষ্ট করব না। সুন্দর লাগবে। ” আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “মেঘ, কথা বললে কথা শুনবি না?” “শুনবো। ”

“তাহলে যা এখান থেকে। আমার অনুমতি ব্যতীত আমার রুমের কোনো জিনিস যদি এদিকসেদিক হয়, সেই কাজ যেই করে থাকুক না কেন, তার দায়ভার কিন্তু তোর হবে। সো বি কেয়ার ফুল। ” মেঘ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিচ থেকে ইকবাল খান আবিরকে ডাকছেন। আবির এগিয়ে গিয়ে মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে অনুগ্র কন্ঠে বলল, ” সারারাত ভাবেন, আগামীকাল আমার রুমের দুটা দেয়াল আপনাকে ডিজাইন করে দিতে হবে। ডিজাইন ভালো না হলে…. ”

“….না হলে কি?” “সেটা না হয় কালকেই বুঝাবো। ” আবির রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। মেঘ দেয়ালের হাতের ছাপের দিকে একবার তাকালো, আবার পাশের দুটা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলো। তারপর রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা মীমের রুমে ঢুকলো। মীম বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে, “আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও” বলতেছে। মেঘ মীমকে আলতো চাপড় মেরে বলল,

“আমাকে বিপদে ফেলে নিজে বাঁচাও বাঁচাও করছিস। লজ্জা লাগে না তোর?” ” লজ্জার যেমন বয়স নাই তেমনি মা-ইর খাওয়ারও বয়স নাই৷ ভাইয়া যেভাবে তাকাইছিল, ভয়েই আমার গলা শুকিয়ে গেছিল। তোমাকে কিভাবে ডাকবো! কথায় আছে, জান বাঁচানো ফরজ৷ ” মেঘ রাগী ভাব নিয়ে বলল,


” তুই বিপদে পড়লে আমিও বলল, জান বাঁচানো ফরজ৷ ” মীম আহ্লাদী কন্ঠে বলল, “আপু….. সরি” মেঘ ভেঙচি কেটে চলে গেছে। মীম পেছন পেছন আপু আপু ডাকছে।



পর্ব - ৫৩ (২)

আলী আহমদ খান আজ ফজরের নামাজ পরে বাসায় এসে পরেছেন। সোফায় হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। সচরাচর নামাজ শেষে ঘন্টাখানেক হাটাহাটি করে তারপর বাসায় ফিরেন, তবে আজ শরীর খারাপ লাগছিল বলে হাঁটতে যান নি। আবির বাসায় ফিরে আব্বুর সাথে একটু কথা বলে নিজের রুমে চলে গেছে। আবিরের পা মোটামুটি ঠিক হলেও শরীর এখনও বেশ দূর্বল। এজন্য আলী আহমদ খান আবিরকে অফিসে যেতে দেন না। বাসায় থেকে যতটা সম্ভব কাজ করে, বাকি সব কাজ ইকবাল খানরায় সামলায়।

ইদানীং আবিরের ঘুম ভাঙার পর পরই মেঘের যত্ন শুরু হয়। পা ঠিক হওয়ার পর থেকে আবির নামাজ পড়তে মসজিদে যায়, নামাজ থেকে ফিরতেই টেবিলের উপর কফি সাথে ইউনিক কিছু নাস্তা সাজানো থাকে। মেঘ তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করেই রান্না করতে যায়, আবির আর নিজের জন্য অল্পসল্প নাস্তা রেডি করে নিজের রুমে লুকিয়ে রাখে, আবির নামাজে গেলে চুপিচুপি আবিরের রুমে নাস্তা রেখে নিজের রুমে চলে আসে। আবির সব বুঝতে পেরেও মেঘকে কিছু বলে না, অবশ্য কিছু বলতেও ইচ্ছে করে না। আবির তার কাদম্বিনীর অতিরিক্ত যত্নে দিনকে দিন মেঘের প্রতি এতটায় আসক্ত হয়ে পরছে যা কোনোভাবেই কাটাতে পারছে না, নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। আবির এক্সিডেন্ট করার পর থেকে আবিরের প্রতি মেঘের দায়িত্ববোধ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে,সেই সাথে বুদ্ধিও বেড়েছে। এখন আর আগের মতো বাসার মানুষদের সামনে পাগলামি করে না, আবির কিছু বললে একবারেই মেনে নেয়, মুখের উপর প্রশ্নও করে না। আবির প্রতিদিনের মতো আজও রুমে এসে টেবিলে নাস্তা রাখা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। নাস্তা শেষ করে আবারও ঘুমিয়ে পরলো। মেঘও নিজের রুমে নাস্তা করে পড়তে বসেছে। নিচে আলী আহমদ খান সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, মালিহা খান কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছেন কোনো সমস্যা কি না! কিন্তু ওনি কিছুই বলেন নি। অনেকক্ষণ পর ইকবাল খান বাজার নিয়ে বাসায় ফিরেছেন, ভাইজানকে মনমরা হয়ে সোফায় এভাবে বসে থাকতে দেখে ইকবাল খানও সোফায় গিয়ে বসলেন, শান্ত স্বরে শুধালেন,

"ভাইজান, তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত? "


"নাহ, তেমন কিছু না। "


"মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করছো, আমায় বলো৷ "


"কি বলবো বল, আবিরের ছন্নছাড়া আচরণগুলো আমাকে খুব ভাবাচ্ছে৷ নিজের মতো ব্যবসা করতে চাইছিল, সেখানে আমি জোর করে ও কে আমাদের ব্যবসায় জড়িয়েছি। আদোতে ওর মনে কি চলছে তাও বুঝতে পারছি না। ভেবেছিলাম ওকে বিয়ে করাতে পারলে, দুশ্চিন্তাটা অনেকটা কমে যাবে কিন্তু ও বিয়েও করবে না বলে দিল ৷ একমাত্র ছেলে, এতবছর দূরে ছিল বাসায় ফেরার পর যেন দূরত্ব আরও বেড়ে গেছে। আবির কে কিছু বলতেও পারি না, বলার আগেই ওর মা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।"


ইকবাল খান মলিন হেসে বললেন,

" ভাইজান তুমি শুধু শুধু টেনশন করছো। দরকার হলে আমি আবিরের সাথে আবার কথা বলবো। "


"আপাতত কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কিছুদিন আবিরকে ওর মতো করেই থাকতে দে। দেখ ওর মতিগতি বদলায় কি না।"


ইকবাল খান মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন৷ দুই ভাইয়ের মুখে কোনো কথা নেই। ইকবাল খান গলা খেঁকিয়ে হঠাৎ উঠে বললেন,

"ভাইজান, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?"


"হ্যাঁ, বল।"


"আফাকে কি তুমি সত্যিই মন থেকে মেনে নিয়েছো? নাকি মনের ভেতর এখনও ক্ষোভ রয়েই গেছে। "


"মন থেকে না মানলে আমার বাড়িতে ঢুকার অনুমতি কোনোদিনও দিতাম না, এটা মাথায় রাখিস।"


"কিন্তু.. "


"কিন্তু কি?"


"মাত্র দুই দিনের সাক্ষাতে আপুদের বাসায় দাওয়াত দিলে। এত সহজে সবটা মানিয়ে নিলে, বিষয়টা সত্যিই অবাক করেছে আমায়। "


আলী আহমদ খান অনচ্ছ হেসে বললেন,

"তোদের চোখে বিষয়টা দুদিনের ঘটনা হলেও আমার কাছে এটা প্রায় ৮-১০ বছর যাবৎ চলমান একটা ঘটনা।"


"মানে.."


"মাহমুদার বিয়ের পর থেকে ১৫-২০ বছরের মতো আমি ওর নামটা সহ্যও করতে পারি নি। কত রাত ওদের উপর রাগ করে না খেয়ে ঘুমিয়েছি তার হিসেব নেই। আগে প্রতিবছর ঈদে বা অন্যান্য সময় বেড়ানোর জন্য প্রায় ই গ্রামে যেতাম, কিন্তু ঐ ঘটনার পর থেকে গ্রামে গেলে আমার পরিবারের নামে আজেবাজে কথা শুনতে হতো, তার জন্য বাধ্য হয়ে গ্রামের সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। নিজের সাজানো সংসার কে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে সব ছেড়েছিলাম,এমনকি ঈদেও বাড়িতে পা দেয় নি। সময় আর বয়সের সাথে সাথে অনেককিছু বদলাতে শুরু করে, কিন্তু আমি আমার নীতি থেকে সরতে পারি নি৷ হঠাৎ একদিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। কথা বলে জানতে পারি সে আমাদের গ্রামের মেম্বারের ছোটভাই মাইদুল । পড়াশোনা শেষে যশোরে চাকরির পোস্টিং হওয়ায় সেখানে যায়, ঐখানে মাহমুদাদের দেখে আমার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে সে আমায় ফোন দিয়ে জানিয়েছে। আমি সেদিন আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি, ওর নামটা শুনে মুখের উপর কল কাটতে পারি নি৷ বোনের প্রতি দূর্বলতায় মাইদুলের বলা সব কথায় শুনেছিলাম। তারপর থেকে মাইদুল মাঝেমধ্যে কল দিয়ে মাহমুদাদের খোঁজখবর জানাতো, কখনো কখনো আমিও কল দিতাম। ওদের ঢাকা আসার খবরও আমি আগেই পেয়েছিলাম, এমনকি আমি মাহমুদা আর ওর মেয়ে আইরিনকে আমি আগেও ২-৩ বার দেখেছি।"


"এতদিন আমাদের কিছু জানাও নি কেনো?"


"কিভাবে জানাতাম? আর কি ই বা জানাতাম!"


"তুমি আফাকে সত্যি মাফ করেছো?"


" যেদিন শুনেছিলাম ওর হাসবেন্ড হার্ট অ্যাটাক করেছে সেদিনই আমি ওদের মাফ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু নিজের নীতি থেকে নড়তে পারি নি, মনের উপর যে শক্ত আবরণ টা পরেছিল সেটাকেও সরাতে পারি নি, নিজের জেদ আর আক্রোশে নিজেই বন্দি হয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ যখন মাহমুদা আর জান্নাতকে দেখলাম আর মাহমুদা আমায় ভাইজান বলে ডাকলো, ওর ডাকে সেদিন মনে হয়েছিল আমার বুকের উপর থেকে ২৮ বছর যাবৎ জমা বিশালাকৃতির পাথর টা যেন মুহুর্তেই বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। ইচ্ছে হয়েছিল ছোটবেলার মতোই সব ভুলে বোনকে কাছে টেনে নিতে, কিন্তু আমি পারি নি। আমার মন সায় দিলেও আমার হাত পা তাতে সায় দেয় নি। তারপর থেকে তোর ভাবি আর আবির, মোজাম্মেল আমাকে অনেক বুঝিয়েছে। তাই সবকিছু ভুলে ওদের ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাঁচবো আর কতদিন! রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে ম*রেও শান্তি পেতাম না৷ "


ইকবাল খান নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। কিছু বলার ভাষা নেই ওনার৷ বোনের প্রতি বড় দুই ভাইয়ের মতো ইকবাল খানের ভালোবাসাও প্রবল ছিল৷ মাহমুদা খান আর ইকবাল খান মোটামুটি সমবয়সী ছিল বিধায় দুজনের সম্পর্কটাও বেশ মজবুত ছিল। মাহমুদা খানের ছায়ায় বড় হওয়া ইকবাল খান হঠাৎ বোনকে হারিয়ে এলোমেলো হয়ে উঠেছিলেন। তার পরপর মাকে হারিয়েছিলেন। সবমিলিয়ে ইকবাল খানের জীবনটা বলতে গেলে অনেকটায় ছন্নছাড়া ছিল। এরপর থেকে বড় দুই ভাইয়ের শাসনেই বড় হয়েছেন। ভাইদের কথামতো ব্যবসার কাজে রাজশাহী থাকতে শুরু করেন আর সেখানে থাকা বাসার মালিকের মেয়ের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে যার পরিণতি হয়েছিল কোনোদিন রাজশাহী বিভাগে পা রাখতে না পারা। সংসারের মায়াজালে আটকে গিয়ে রাজশাহীর রমনীকে ভুলতে পারলেও বোনের প্রতি দূর্বলতা কাটাতে পারেন নি, ঢুকরে কেঁদেছেন বহুরাত।


সকালের খাবার খেয়ে তিনভাই অফিসে চলে গেছেন। মোজাম্মেল খান আবিরকে অফিসে যেতে বলেছিলেন কিন্তু আবির আজ ইচ্ছে করেই অফিসে যায় নি৷ আবির রুমে না থাকলে মেঘ আবিরের সব জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করতে পারে, সেই ভেবেই আবির কোথাও যায় নি। প্রায় ১১.৩০ নাগাদ মেঘ আবিরের রুমে আসছে। আবির রঙ সহ প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম আগেই আনিয়ে রেখেছিল৷ মেঘ মিষ্টি কন্ঠে শুধালো,


"এখন আর্ট করবো?"


"তোর যখন ইচ্ছে করতে পারিস৷ আমার কোনো সমস্যা নেই। "


" আমার পছন্দের ডিজাইন এঁকে দিব?"


"অবশ্যই।"


মেঘ নেট থেকে দেখে কয়েকটা সুন্দর ডিজাইন আগেই বের করে রেখেছিল সেগুলোর একটায় এখন করতেছে । মেঘের পড়নে সুতি কাপড়ের থ্রিপিস,গলায় ওড়নাটা দু প্যাঁচ দিয়ে সামনের দিকে রেখেছে, ঘন,কালো, লম্বা চুলগুলো আজ আগে থেকেই সামলে এসেছে, চুলগুলো পেঁচিয়ে কাঁকড়া দিয়ে আঁটকে নিয়েছে। মেঘের ঘাড় উন্মুক্ত, ছোট ছোট চুল গুলো ঘাড়ে পড়ে আছে। আবির ল্যাপটপে কাজ করছে আর মাঝে মাঝে মেঘের দিকে তাকাচ্ছে। মেঘ সরাসরি না দেখলেও, আবিরের নজর সে ঠিকই বুঝতে পারছে। অস্বস্তিতে বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে, নাকের ডগায়, কপালে, থুতনির উপরে ঘাম জমে একাকার অবস্থা হয়ে গেছে। হঠাৎ আবিরের ফোনে কল বেজে উঠলো, আবির যথারীতি ফোন কানে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। আবির বের হতেই মেঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবির রুমে নেই দেখে মেঘ কাজের গতি বাড়াচ্ছে, তাড়াতাড়ি ডিজাইন শেষ করে পালাতে পারলেই বাঁচে। আচমকা মীম দরজায় দাঁড়িয়ে কাশতে শুরু করলো৷ মেঘ বুঝতে পেরেও পেছন ফিরে তাকালো না। মীম রুমে না ঢুকে দরজায় দাঁড়িয়ে কেশেই যাচ্ছে। মুহুর্তেই মেঘের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে, মীমের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে হুঙ্কার দিল,


" আজকে আমায় জ্বালালে তোর খবরই আছে। "


মেঘের ধমক খেয়ে মীমের ঠোঁট ভেঙে আসছে। মীম ব্যগ্র কন্ঠে বলল,

" সরি আপু৷ আমি তোমাকে জ্বালাতে আসি নি। শুধু দেখতে আসছিলাম কোন ডিজাইন টা করতেছো। "


মেঘ শীতল কণ্ঠে বলল,

"ভেতরে এসে দেখে যা কোনটা করছি।"


সঙ্গে সঙ্গে মীমের মুখে হাসি ফুটলো, ছুটে গেল রুমের ভেতর৷ মীমের উত্তেজনা দেখে মেঘ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,


"দেখিস, রুমের কোনো জিনিস নষ্ট করিস না যেন।"


মীম সম্পূর্ণ রুমে চোখ বুলিয়ে আমুদে কন্ঠে বলল,

"ওমা, এখন থেকেই ভাইয়ার রুমের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছো?"


মেঘ মুচকি হেসে বলল,

" আমি দায়িত্ব নিবো না তো কে নিবে!"


মীম হেসে বলল,

"আমিও সেটায় বলি, মনি মুক্তা তো আর দায়িত্ব নিতে পারবে না৷ "


মেঘ কপাল কুঁচকে ভারী কন্ঠে শুধালো,

"মনি মুক্তা কে?"


মীম হাসতে হাসতে বিছানার পাশে বসে পরেছে। মীমের হাসি দেখে মেঘের চোখ আরও সরু হয়ে গেছে, কপালে কয়েক স্তর ভাজ ফেলে তাকিয়ে আছে। মীম ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,

" ধরো তোমার স..."


মেঘ চেঁচিয়ে উঠে বলল,

"মীম..... "


মীম দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ রাগে কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে পুনরায় কাজে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ পর মীম আবার আসছে। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মোলায়েম কন্ঠে ডাকলো,


" আপু..."


"আবার কি হয়ছে?"


"তোমাকে দেখতে আসছি।"


"কেন? আমার কি রূপ বের হয়ছে?"


" তোমার এই রূপের আগুনে ভাইয়া এমনিতেই পাগল হয়ে গেছে, এরচেয়ে বেশি রূপ যদি বের হয় তাহলে ভাইয়া আর সহ্য করতে পারবে না। "


"মীম, তোর মুখটা বন্ধ রাখবি? ওনি যদি এসব কথা শুনতে পায় তোকে আর আমাকে দুটাকেই আধম*রা করে ফেলবে।"


"তোমার ওনি নিচে বসে বসে প্রেম করতাছে। এখন আসবে না। "


"কার সাথে প্রেম করে?"


" হবে তোমার চেয়েও সুন্দরী কেউ। "


মেঘ রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

"তুই যাবি এখান থেকে?"


মীম বিড়বিড় করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মৃদু বাতাসে মেঘের সামনের দিকের ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে, চোখ মুখে ঝাপটে পরছে, মেঘের দুহাতে রঙ ভরে আছে, তাই ঠিক করতে পারছে না। মীমের সাথে কথা বলতে বলতে মেঘ হাতের কব্জি দিয়ে চুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারছে না। বাধ্য হয়ে পুনরায় ডাকল,


" মীম...!"


ততক্ষণে মীম বেড়িয়ে গেছে। বেলকনিতে আবিরকে আসতে দেখে মীম দ্রুত পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেছে। মেঘ উচ্চ স্বরে মীমকে ডাকছে। মেঘ যে দেয়াল ডিজাইন করছে সেটা থেকে দরজা সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থিত। রুমে হঠাৎ কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে মেঘ বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল,

"এতক্ষণ ধরে ডাকছি আসছিলি না কেন? আমার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে যা।"


আবির বিছানার উপর ফোন রেখে মেঘের কাছে এগিয়ে গেল। মেঘের কাছাকাছি এসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,


"এদিকে ঘুর।"


আবিরের কন্ঠ শুনে মেঘ চমকে উঠে পেছনে ঘুরলো। মেঘ পেছনে ঘুরতেই আবিরের ঘনিষ্ঠতা অনুভব করল। আবির ঠিক মেঘের সম্মুখে দাঁড়ানো, মাঝখানে কেবল কয়েক ইঞ্চির গ্যাপ। আবিরের গা থেকে আসা তীব্র গন্ধে মেঘের মা*তাল হওয়ার অবস্থা। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সামলাতে মেঘ ঢোক গিলে উষ্ণ কন্ঠে বলল,


" স সরি, আমি ভেবেছিলাম মীম আসছে।"


আবির নেশাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,


"কেন? আমি ঠিক করে দিতে পারি না?"


মেঘের হৃৎস্পন্দন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে, মস্তিষ্কের নিউরনে অনুরণন হচ্ছে, শ্বাসনালিতে তুফান, গলা শুকিয়ে কাঠ। উত্তর দেয়ার মতো অবস্থা নেই। জানালা দিয়ে আসা আনম্র পবনে মেঘের ছোট-বড় চুলগুলো দুলল বাতাসে , দু একটা চুল চোখে লাগতেই মেঘ চোখ বন্ধ করে ফেলল৷ চোখ বন্ধ রেখেই, মেঘ চুল সরানোর জন্য রঙে রাঙানো হাত তুললো, আবির সহসা মেঘের হাতের কব্জিতে ধরে থামিয়ে দিল। আবিরের স্পর্শে মেঘ আবারও চমকে উঠে। মেঘ হতভম্ব হয়ে তাকালো। কয়েক মুহুর্ত নিগূঢ় দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। মেঘের এক হাত আবিরের হাতে বন্দি, বাতাসের হাত থেকে চোখকে বাঁচাতে মেঘ এবার অন্য হাত তুলতে নিল, মেঘের আগে আবির ই নিজের অন্য হাত দিয়ে মেঘের কপালে দু আঙুল ছুঁইয়ে কপাল থেকে চুল সরিয়ে কানে গুজে দিতে লাগতো। আবিরের অনমনীয় হাতের স্পর্শে মেঘের ভেতরটা ছটফট করছে। আবেশে মেঘের দুচোখ বন্ধ হয়ে গেছে। আবির খুব যত্নসহকারে দুই-তিনবারে চুল সরানোর চেষ্টা করলো। মেঘ নিজেকে সামলে আচমকা চোখ মেললো, নিজের মনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উচ্চস্বরে বলল,


" ছাড়ুন আমায়। "


আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

"ছাড়তেই যখন বলবি তবে এত আকৃষ্ট করিস কেনো আমায়?"


আবিরের কথা শুনে মেঘ বিপুল চোখে তাকালো। আবিরের বিশ্রান্ত চাহনিতে মেঘের অনুভূতির আকাশ জুড়ে প্রজাপতিরা ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে। মেঘের আদলে লেপ্টে আছে প্রমত্ততা৷ মনে অনুরাগের সুর বাজছে।মেঘের বয়ঃসন্ধির প্রথম প্রেম আবির ভাই। সেই আবির ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা উন্মাদ করে তুলছে মেঘকে৷ আবিরের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব বহুদিন আগেই মেঘের মনকে দূর্বল করেছিল, আবির ভাই নামক অসুখ বাসা বেঁধেছিল ছোট্ট মেঘের মনে। যে অসুখ সারানোর ঔষধ আজও আবিষ্কৃত হয় নি৷ আবির নিরেট দৃষ্টিতে মেঘকে দেখেই যাচ্ছে, মেঘও বৃহৎ আঁখিতে তাকিয়ে আছে আবিরের চোখের দিকে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। মেঘ ঘোরের মধ্যে থেকেই অকস্মাৎ পেছনে চলে যাচ্ছে। দু থেকে তিন কদম পেছাতেই আবিরের হাতে থাকা মেঘের হাতটা টান পড়ে, ওমনি আবিরের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। দেয়াল ভর্তি ভেজা রঙ, মেঘ বেখেয়ালি ভাবে পেছাচ্ছে দেখে আবির মেঘের হাতের কব্জি ধরে টান দিতেই মেঘের ছোট্ট দেহ আবিরের পেট আর বুকের মাঝামাঝি অবস্থানে ধাক্কা লাগে। আচমকা আক্রমণে মেঘের গা কেঁপে উঠলো। মেঘের দৃষ্টি আবিরের বুকের দিকে। আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তপ্ত স্বরে বলল,


" কারো প্রণয়ের পরিণীতা হতে চাইলে তার অনুষঙ্গের নিগূঢ়তা সহ্য করার প্রবলতা থাকতে হবে। অনাড়ম্বরে কাঙ্ক্ষিত অভিলাষ অপূর্ণ থেকে যাবে৷ "


মেঘ কোনোভাবেই ধাতস্থ হতে পারছে না। হতবিহ্বলতায় মেঘের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মেঘের মনে একটা প্রশ্ন আচমকা আঘাত হানলো,

" ঐদিন রাতে কি আবির ভাই সজাগ ছিল? তবে কি আমার সব কথা শুনে ফেলেছেন?"


লজ্জায় মেঘের চিবুক নেমে গেছে, আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবিরের হাতে বন্দি নিজের হাতটার দিকে৷ নিজেকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই। দিশাহারা হয়ে আবিরের কাছ থেকে কিছুটা পিছিয়ে আসলো। আচমকা আবির মেঘের হাত ছেড়ে তড়িৎ বেগে মেঘের কোমল অনৃজু কোমড় আঁকড়ে ধরলো। ওমনি মেঘের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেছে। আবির এক টানে মেঘকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললো। মেঘ প্রখর নেত্রে তাকালো আবিরের দিকে, চোখ দুটা রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস গলায় আঁটকে গেছে। আবিরের সম্মোহনী দৃষ্টিতে মেঘের মন তুষারের ন্যায় জমে গেছে। প্রত্যাশিত ব্যক্তির অপ্রত্যাশিত স্পর্শ ভেঙেচুরে দিচ্ছে মেঘের পিঞ্জরে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডকে। দীর্ঘসময় পর মেঘ সর্বশক্তি দিয়ে নিজের ভেতরের আবদ্ধ নিঃশ্বাস টা ছাড়লো। মেঘের ধাঁরালো চাউনির নিকট আবির আজ বারংবার ধৃত হচ্ছে তবুও মেঘের স্নিগ্ধ ধৃষ্টতা থেকে নজর সরাতে ব্যর্থ হচ্ছে। মেঘের শরীর মাত্রাতিরিক্ত ঘামতে শুরু করেছে। মুহুর্তেই সুতি জামা ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। মেঘের শরীরের তীব্র কম্পনে আবিরের হাতও কাঁপছে। ঘামের কারণে জামার উপর দিয়েই আবিরের হাতের পাঁচ আঙুল ভিজে গেছে। মেঘ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবির গভীর দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে আর ঠোঁট চেপে হাসছে। মেঘ ভুলে গেছে হাত ভর্তি রঙের কথা, মুখের ঘাম মুছতে হাত তুলতেই আবির অন্য হাত দিতে মেঘের হাত স্পর্শ করলো, মেঘের হাতে লেগে থাকা ঘন রঙে আবিরের হাত ভরে গেছে, মেঘের দৃষ্টি সেদিকে পড়তেই তাড়াতাড়ি হাত সরাতে চাইলো। ততক্ষণে আবিরের পাঁচ আঙ্গুলে মেঘের আঙুলগুলো বন্দি হয়ে গেছে। মেঘ সুদীর্ঘ সময় নিয়ে শ্বাস ছেড়ে আর্তনাদ করে বলতে নিলো,


"আমাকে ছা.."


আবির মেঘের হাত ছেড়ে এক আঙ্গুলে মেঘের ঠোঁট স্পর্শ করেছে। মেঘ সহসা নিশ্চুপ হয়ে গেছে, আবিরের আঙুলের রঙ মেঘের ঠোঁটে লেগে গেছে। মৃদু বাতাসে মেঘের চুলগুলো হালকা ভাবে উড়ছে। ভেতরের কম্পনে মেঘের সেদিকে খেয়াল নেই, আবির আলতো হাতে মেঘের চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। রঙের কারণে চুলগুলো একে একে রঙে আটকে গেছে, চুল সরাতে সরাতে আবিরের দৃষ্টি মেঘের গালে আঁটকালো। বাহির থেকে আসা আলোতে মেঘের গালটা অতিরিক্ত আদুরে দেখাচ্ছে, আবির নিজের মন আর হাত কোনেটাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। না চাইতেই রঙে রঙিন হাতে মেঘের গাল ছুঁয়ে দিল, কয়েক মুহুর্ত গালে হাত রেখে ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে গলার একপাশে ঘাড়ে হাত ছুঁড়ালো। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে মেঘ নিরস্ত হয়ে গেছে, আবিরের কর্মকান্ডে মেঘের সব শক্তি বিলীন হয়ে গেছে। মেঘের গালে আবিরের পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। আবির মেঘের ঘাড়ে হাত রেখে কিছুটা নিচু হয়ে অন্যপাশে মেঘের ঘাড়ের কাছে মুখ এগিয়ে নিল। আবিরের তপ্ত নিঃশ্বাস ছুঁয়ে দিচ্ছে মেঘের মসৃণ গ্রীবা। মেঘ দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আবিরের সুগভীর কন্ঠস্বর ভেসে উঠল,


" এটুকুতেই এই অবস্থা হলে কিভাবে কি হবে?"


আবিরের নেশাক্ত কন্ঠে বলা কথা মেঘের কর্ণপাত হলো না, আবিরের স্পর্শ আর নিঃশ্বাসেই মেঘ পাথর বনে গেছে। আবির আবেশিত কন্ঠে পুনরায় বলল,


" ম্যাম,নিজেকে সামলান, আমি কিন্তু আমাতে নেই। কোনো অনিষ্ট হলে আমি একা কুলষিত হবো না, আপনাকে নিয়েই হবো।"


আবিরের কথা মেঘের কানে ঢুকছে কি না কে জানে, মেঘ বরফের ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আবির মেঘকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়েছে৷ মেঘ তখনও পূর্বের জায়গায় দাঁড়ানো। দেখে বুঝায় যাচ্ছে, নিজের সেন্সে নেই। আচমকা মেঘ পেছাতে শুরু করে, দেয়ালে আটকানোর পূর্বেই আবির এগিয়ে এসে মেঘের চুলের খোঁপার ঠিক পেছনে দেয়ালে এক হাত রাখলো, যেন মেঘের চুলে রঙ না লাগে। অন্য হাতে দেয়াল ধরে নিজেকে আটকালো। মেঃ ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,


"আমি রুমে যাব।"


আবির মিটিমিটি হেসে শুধালো,

"শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?"


মেঘ চিবুক নামিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

"হ্যাঁ!"


আবির মনে মনে বিড়বিড় করল,

"কিছু করলামই না, এতেই নাজেহাল অবস্থা। কিছু করলে তো আপনাকে খোঁজে ই পাওয়া যাবে না। এই আবার আপনি আবিরের প্রণয়িনী হতে চান!"


মেঘ শীতল কণ্ঠে বলল,

"সরুন আমি চলে যাব। রঙ পরে করে দিব।"


আবির মৃদুস্বরে বলল,

"আপনার ইচ্ছে। "


আচমকা বেলকনি থেকে তানভির ডাকলো,

"ভাইয়া আসবো?"


মেঘ তানভিরের কন্ঠ শুনে থতমত খেয়ে উঠল। গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ৷ মেঘ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,


"ভাইয়া আসছে, সরুন প্লিজ।"


আবির ভ্রু কুঁচকে শক্ত কন্ঠে বলল,

"তোর ভাইকে কি আমি ভয় পাই নাকি?"


আবির তানভিরকে উদ্দেশ্য করে উচ্চ স্বরে বলল,

"নাহ। ব্যস্ত আছি। "


"তুমি যেগুলো আনতে বলছিলে সেগুলো নিয়ে আসছি। "


"তোর কাছে রাখ, পরে দেখে নিয়ে আসবো। "


"আমি আবার বেড়িয়ে যাব৷ ফিরতে রাত হবে। তোমার রুমে রেখে যায় "


আবির বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,

"উফফফ, রেখে যা।"


মেঘ উপায় না পেয়ে আবিরের প্রশস্ত বুকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো, ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তানভির বিছানায় কিছু কাগজ আর ২-৩ টা বক্স রাখতে রাখতে বলল,


"তোমার.."


বলতেই মেঘকে অল্পবিস্তর চুপ করে গেল। কপাল গুটিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে কান হাত দিয়ে বিড়বিড় করে "সরি" বলল। আবির চোখে ইশারা করতেই তৎক্ষনাৎ নিজের মাথায় চাপড় মারতে মারতে বেড়িয়ে যাচ্ছে, যেতে যেতে দরজা টাও চাপিয়ে রেখে গেছে। তানভির নিজের কপাল চাপড়ে বেলকনিতে হাঁটছে আর বলছে,


"ছিঃ তানভির, ছিঃ। তুই এত নির্লজ্জ কেন?"