সালমা চৌধুরী
সালমা চৌধুরী

প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | প্রণয়ের পরিণীতা

৪০ ভিউ
০ মন্তব্য
১ মিনিট

আবিরের ক্রন্দিত কন্ঠে বলা কথাটা মেঘের কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্রই মেঘ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেছে। মেঘের বুক ধড়ফড় করছে, গাত্র জুড়ে রক্ত সঞ্চালন তীব্র থেকেও তীব্র হতে শুরু করেছে, বুকের বাম প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ হৃদপিণ্ডে বেধক নাভিশ্বাস অনুভূত হচ্ছে। আবির ভাইয়ের সংগুপ্ত প্রণয়ের অনলে বারংবার আহত হওয়া মেয়েটার হৃদয় আজ আবিরের আর্তনাদে সম্পূর্ণ তছনছ হয়ে গেছে।

ভীতিকর, অযাচিত পরিস্থিতি সামলানোর অণুমাত্র সামর্থ্য মেঘের নেই। মেঘ ক্ষুদ্র আলোতে আশ্চর্য নয়নে চেয়ে আছে আবিরের পরিশ্রান্ত ধৃষ্টতায়, আবিরের হাতে থাকা মেঘের হাতটা থরথর করে কাঁপছে, ক্ষণিকের ব্যবধানে মেঘের অক্ষিপট ভিজে এসেছে। আবির ভাই সরি বলছেন, কিন্তু কেনো? চোখের সামনে ঘটা সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ অবসহন করতে মেঘের নিজের সাথে নিজেকে প্রভূত বিগ্রহ করতে হয়েছে। মনের আস্তিনের টালমাটাল হাল সামলে মেঘ ভয়ার্ত গলায় জানতে চাইল,


” আপনার কি হয়েছে? ” কান্নার তোপে আবিরের কপালের পাশের শিরা উপশিরাগুলো দপ দপ করছে, রক্ত বর্ণের আঁখি যুগল আরও বেশি রক্তাভ হয়ে গেছে। আবিরের লাগামহীন ক্রন্দনের সমাপ্তির রেশ মাত্র নেই৷ মেঘের চোখ ছলছল করছে, দুহাত বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরের ঘনীভূত নভশ্চর সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেঘ ভেজা কন্ঠে আবারও প্রশ্ন করল, “আবির ভাই, আপনি কাঁদছেন কেনো?”

আবির ঢোক গিলে মুখ তুলে মেঘের অভিমুখে চাইলো। আবিরের চোখ মুখের ধরণ অত্যন্ত গুরুগম্ভীর, চেহারায় বিন্দুমাত্র লাবন্য নেই। মেঘের তুষারের মতন ঠান্ডা দুহাত আবির অতর্কিতেই নিজের গালে রাখলো, সহসা আবিরের চওড়া দুহাত দিয়ে মেঘের ছোট ছোট হাতকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলেছে। আবিরের গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সেই সাথে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজলের স্পর্শে মেঘের সর্বাঙ্গে শীতল হাওয়া বইছে। প্রণয়ের পূর্ণতা পাওয়ার শাণিত আক্ষেপে যে ধ্বংসের খেলায় নেমেছিল সেই ধ্বংসলীলা প্রতিনিয়ত ব*ধ করছে মেঘের নিষ্কলুষ হৃদয়কে। মনের গহীনে এক বছরে আত্মগোপনে মন্থর গতিতে বেড়ে ওঠা অভিমানের ভাপগুলো আজ আবিরের নিগূঢ় সংস্পর্শে অনুযোগে রূপ নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। নিদারুণ ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতে মেঘ হতবিহ্বল হয়ে আছে, লুকোচুরি প্রেমগুলো মনের অন্তরালেই নিথর হয়ে গেছে। আবিরের নিরেট দৃষ্টিতে উদ্বেগ স্পষ্ট, আবির আস্তে করে গলা খাঁকারি দিয়ে অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বলল,

” অপ্রসন্নতায় ঘেরা জনপদে আমি না চাইতেও বিশল্যকরণীর কবলে পড়ে গেছি। পুঁথিগত শব্দে তোকে বুঝাতে আজ আমি অক্ষম। প্রয়োজনে সমস্ত বিপর্যয় নিরবতায় সয়ে যাব, তবুও ব্যর্থতা সইতে পারবো না। ” মেঘ শান্ত স্বরে নির্দ্বিধায় বলল, “আপনাকে ব্যর্থতা সইতে হবে না৷ আমি সবসময় দোয়া করি যেনো আপনি সবকিছুতে সফল হতে পারেন। আমার বিশ্বাস আপনি সফল হবেন, ইনশাআল্লাহ। এবার অন্তত থামুন,প্লিজ। ” আবির ভেজা চোখেই মুচকি হেসে বলল, ” তবে যে কাউকে অনেকবেশি সহিষ্ণু হতে হবে।” মেঘ উদ্বেলহীন কন্ঠে জানাল,

” কারো সহিষ্ণুতায় যদি আপনার সাফল্য অর্জিত হয়, তবে সে অমেয় সহিষ্ণু হবে।” আবির মেঘের হাতের উপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে মলিন হেসে ঠান্ডা কন্ঠে বলল, “অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাতে যান এখন। ” মেঘ চিন্তিত কন্ঠে শুধালো, “আর আপনি?” “একটু পর যাব।”

মেঘ নিজের ওড়নার একপাশ টেনে আলতোভাবে আবিরের চোখ-মুখ মুছে দিচ্ছে। আবির চোখ বন্ধ করে মেঘের স্নিগ্ধতা অনুভব করছে। এতক্ষণ কান্নার কারণে বুঝতে না পারলেও এখন মেঘের গায়ের গন্ধে আবির মত্ত হয়ে যাচ্ছে। মায়াবতীকে ছুঁতে চাওয়ার উন্মাদনা আঁকড়ে ধরেছে আবিরকে। হৃদয়ের ক্ষত প্রতিহত করার ক্ষমতা আবিরের থাকলেও মেঘের প্রতি অগাধ অনুরক্তি লুকিয়ে রাখার সামর্থ্য আবিরের নেই। মেঘের অনাবশ্যক যত্নে আবিরের বুকে অদ্ভুত শিহরণ জাগছে৷ আবিরের মনে মেঘকে নিয়ে সর্বদায় সংশয় কাজ করে। মেঘ যেদিন আবিরের চোখে চোখ রেখে আবিরের অনুভূতি জানতে চাইবে সেদিনই আবিরের সবকিছু ছারখার হয়ে যাবে। কারণ ঐ চোখে চোখ রেখে আবির কখনো মিথ্যা বলতে পারবে না। অন্যদিকে নিজেকে নিজে কথা দিয়েছে,

“মেঘকে প্রতিশ্রুতি দিবে না,বউ করে নিজের অঢেল ভালোবাসার সমক্ষ প্রমাণ দিবে।মেঘের কান্না চিরতরে মুছে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে।” সেসব কিছু ভেবেই বারংবার আহত হয় আবির। মেঘকে সম্পূর্ণ নিজের করে নিতে পারছে না, পরিবার নাম বেড়াজালে বাঁধা পড়ে আছে। এদিকে মেঘের কান্না কমার বিপরীতে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আবির প্রতিনিয়ত নিজেকে দায়ী করছে আর অন্তরের উত্তাপে নিজেই ঝলসে যাচ্ছে। মেঘ আবিরের চোখ-মুখ মুছে শীতল কণ্ঠে বলল,

” আমাকে রুম পর্যন্ত দিয়ে আসু্ন।” আবির ভ্রু কুঁচকে ক্ষীণ স্বরে বলল, ” আসছিলেন কিভাবে? ” মেঘ চট করে বলে ফেলল, ” যেভাবেই আসি না কেন, তাতে আপনার কি? এখন আমাকে দিয়ে আসবেন, চলুন।”

আবির আড়চোখে মেঘের পানে তাকালো, ক্ষুদ্র আলোতেও মেয়েটার ক্রোধিত মুখশ্রী জ্বলজ্বল করছে। আবির মৃদু হাসলো, আবিরের হাসি দেখে মেঘ হতাশ হয়ে ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে আকুল কন্ঠে বিড়বিড় করে বলল, ” ঐ যে দেখুন, দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁনারা আমাকে দেখে কেমন করে হাসছে৷” মেঘের আজগুবি কথা শুনে আবির না হেসে থাকতে পারলো না ৷ অকস্মাৎ জোরে শব্দ করে হাসতে শুরু করেছে। আবিরের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছে বলে মেঘ আহ্লাদে গলে যাচ্ছে। আবিরের হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ালো,

” আপনি যতবার নিরাশ হবেন, আমি ঠিক ততবার আপনার মনে আশার আলো জ্বালাবো। আমৃত্যু আপনার পাশে হিতৈষীর ছায়া হয়ে থাকবো।” আবেগে আপ্লুত মেঘের রঙিন ধৃষ্টতার অন্ধকার মুহূর্তেই সরে গেছে। রঙ বেরঙের স্বপ্নে সেজে ওঠেছে মনের আঙিনা। আবিরের নজর মেঘের দিকে পড়তেই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভ্রু নাঁচালো। মেঘ লজ্জায় চিবুক নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ” আপনার হৃদয়ে অনূভুতি সমাপ্তির পূর্বেই নবরূপে সৃজন করবো তৃপ্তির নিকেতন। ” আবির বসা থেকে দাঁড়িয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল, “ম্যাম,চলুন।”

আবির হাঁটছে মেঘও আবিরের পিছুপিছু হাঁটছে। কিছুটা আলোকিত ছাদ পেরিয়ে দরজার কাছে আসতেই মেঘ চোখে অন্ধকার দেখছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সত্যি সত্যি যদি তাঁনারা এখানে থাকে।মেঘ ভয়ে আবিরের শার্ট খামচে ধরেছে। মেঘের অধীরতা বুঝতে পেরে আবির একটু থেমে মেঘের পিঠ পেরিয়ে অন্যপাশের কাঁধে আলতোভাবে হাত রেখেছে। অকস্মাৎ মেঘ চিৎকার দিয়ে উঠেছে,

“আ………..” আবির তড়িৎ বেগে মেঘের মুখ চেপে শক্ত কন্ঠে বলল, ” আরে পাগল, আমি ধরেছি। তাঁনারা ধরে নি।” মেঘ আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল, “আপনি এভাবে ধরেছেন কেনো? আমি ভয় পেয়ে গেছি। বলে ধরবেন না?” আবির নাক মুখ কুঁচকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “আপনাকে ছুঁতে গেলে অনুমতি নিতে হবে?”

মেঘ মন মরা হয়ে বলল, ” অন্ধকারে ভয় লাগে।” আবির কিছুটা সরে গিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, “তোর কাছে ফোন আছে না? ফ্ল্যাশ জ্বালা।” “No need.” “কেনো?” মেঘ দু’হাতে আবিরের বাহু চেপে ধরে বলল, “আপনিই আছেন। ” আবির নিঃশব্দে হেসে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। মেঘের রুমের সামনে আসতেই মেঘ শান্ত স্বরে বলল, ” আপনি কিন্তু এখন আর ছাদে যাবেন না। ” “কেনো?”

“আপনি রুমে না থাকলে আমার ভয় লাগে। ” আবির কপাল গুটিয়ে বলল, ” আমার রুমে আমি থাকার সাথে আপনার ভয় পাওয়া না পাওয়ার কি সম্পর্ক?” মেঘ সাফাই দেয়ার স্বরে বিড়বিড় করে বলল, ” মন কে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য পাশের রুমে মানুষ থাকা আবশ্যক। আপনার রুম ফাঁকা থাকলে তাঁনারা আমাকে ভয় দেখানোর সুযোগ পেয়ে যাবে।” আবির নিঃশব্দে হেসে বলল, ” এত বছর যে আমার রুম ফাঁকা ছিল৷ তখন মনকে কিভাবে সান্ত্বনা দিতেন?” মেঘ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, ” আপনি এত কথা বলেন কেন? ছাদে যেতে বারণ করেছি মানে যাবেন না।” কথাটা বলেই মেঘ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। আবির ভ্রু কুঁচকে দু আঙুলে মেঘের নাকে আলতোভাবে চেপে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

” সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দিলেই হয়, মিথ্যা অজুহাত দেখানোর কি প্রয়োজন? হুমমমমম।” মেঘ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু ফেলেছে। আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “ঘুমান আপনি, আমিও ঘুমাতে যাচ্ছি। ” মেঘ ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল।

সময় চলছে নিজস্ব গতিতে। আরও একটা ঈদ কেটে গেছে। মোজাম্মেল খানের কথামতো এবার সব দায়িত্ব আবির আর তানভির একায় সামলিয়েছে। গত ঈদে মেঘ শুধু আবির, তানভিরকে পাঞ্জাবি দিলেও এই ঈদে সবার জন্য পাঞ্জাবি ডিজাইন করেছে। আর পাঞ্জাবিগুলো মোজাম্মেল খান নিজে গিয়ে পছন্দ করে নিয়ে আসছিলেন৷ মেঘের পরীক্ষার জন্য আপাতত বিয়ের ব্যাপারে মোজাম্মেল খান কোনো কথাবার্তা বলছেন না তাই আবির আর তানভির দুজনেই বেশ নিশ্চিন্ত। বাসার সবাই নিজেদের মতো বেশ শান্তিতে আছে। ইকবাল খান মাঝে মাঝেই আবিরের রুমে গিয়ে আবিরকে আলাদাভাবে বুঝিয়ে আসেন। আবিরের সাথে মেঘের সম্পর্কও আগের থেকে বেশ ভালো হয়েছে। দুজনের মধ্যে ছোটখাটো খুনসুটি সর্বক্ষণ লেগেই থাকে। একে অপরকে ভালোবাসে, দু’জন দু’জনের ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারে তবুও মুখ ফোটে কেউ কাউকে ভালোবাসি বলতে পারে না।

আবির যেমন নিজের গন্ডিতে বাঁধা তেমনি মেঘও নিজের গণ্ডিতে বন্দি হয়ে আছে। মিনহাজের ঘটনার পরপর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ” যতদিন পর্যন্ত আবিরের প্রণয়ের প্রমাণ পাবে না ততদিন পর্যন্ত মেঘ আবিরকে কিছুই বলবে না।” ধীরে ধীরে মিনহাজদের সাথেও মেঘের সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়েছে। তানভির নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে তবে সময় পেলে আবিরের গাড়ি নিয়ে ভাই বোনদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে। ফুপ্পিদের বাসার সাথেও যোগাযোগ ভালো হয়েছে। ১৫ দিন কিংবা মাসে একবার হলেও যাতায়াত হয় । সবার সম্পর্ক ভালো থাকলেও মীম আর আরিফের সম্পর্ক এখনও টম & জেরির মতো। মেঘ একটুর জন্য চোখের আড়াল হলেই মীম কোনো এক অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। আরিফ প্রথম প্রথম আম্মুর কথা ভেবে মীমের দুষ্টামি সহ্য করলেও এখন আর করে না। সুযোগে দুটায় দুটার পিছনে লাগে।

আজ সকাল থেকেই শিমুল আর সোহাগ তানভিরকে কল দিচ্ছে। অনেকদিন যাবৎ বন্ধুদের সাথে দেখা হচ্ছে না। তাই তানভির বিকেলের দিকে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে বেড়িয়েছে৷ শিমুল আর সোহাগ দু’জনেই আগে থেকে উপস্থিত। একসঙ্গে ঘুরাঘুরি করে আড্ডা দিচ্ছিলো আর চা খাচ্ছিলো৷ তানভির চায়ে চুমুক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই সহসা ভ্রু কুঁচকালো। বন্যা কিছু জিনিসপত্র নিয়ে একা একা হনহন করে যাচ্ছে। তানভির চায়ের কাপ রেখে তড়িঘড়ি করে উঠে বলল,

“তোরা বস, আমি আসতেছি।” সোহাগ ধীর কন্ঠে শুধালো, “কোথায় যাচ্ছিস?” তানভির মেকি স্বরে জবাব দিল, “প্রেম করতে।” তানভির যেতে যেতে বন্যা অনেকটায় সামনে চলে গেছে। তানভির পেছন থেকে ডাকলো, ‘বন্যা। ‘ আচমকা পুরুষালি কন্ঠে নিজের নাম শুনে বন্যা ফিরে তাকালো। তানভিরকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম। ” “ওয়ালাইকুম আসসালাম। পরীক্ষা কেমন হলো?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো।” কোথায় গিয়েছিলে?” “একটা ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছিলাম আর কিছু কেনাকাটা করেছি।” তানভির হাত বাড়িয়ে বলল, “ব্যাগ টা আমাকে দাও। আমি এগিয়ে দিয়ে আসছি। ” বন্যা তড়িৎ বেগে বলল,

“নাহ। আমি নিতে পারবো। ” “বিশ্বাস রাখতে পারো, তোমার ব্যাগ নিয়ে পালাবো না আমি।” বন্যা ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” আমি কি একবারও বলেছি আপনি পালাবেন?” “তাহলে ব্যাগটা দাও। ” ব্যাগ নিতে গিয়ে বন্যার হাতে তানভিরের হাত লাগতেই বন্যা তৎক্ষনাৎ ব্যাগ ছেড়ে হাত সরিয়ে ফেলেছে। তানভিরের তপ্ত স্পর্শ অনুভব হতেই বন্যার বুক কেঁপে উঠছে। তানভির ব্যাগ ধরে বিস্ময় সমেত তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

“কোনো সমস্যা? ” “নাহ।” তানভিরকে কে বুঝাবে, বন্যার কাছে তানভির মানুষটায় সমস্যা। বন্যা যতটা সম্ভব তানভিরের থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে তবুও ততটা পারে না। কোনো না কোনোভাবে মানুষটার সাথে দেখা হয়েই যায়। বন্যা স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “আপনি এখানে কেনো আসছিলেন?” “বন্ধুরা দেখা করার জন্য বার নার কল দিচ্ছিলো। তাই আসছি।”

“এখানে চলে আসছেন যে। বন্ধুরা খোঁজবে না? আমাকে ব্যাগটা দিয়ে বন্ধুদের কাছে যান, আমি নিতে পারবো।” “এত কথা বলো কেনো তুমি? আমি সাথে যাচ্ছি এটা ভালো লাগছে না?” তানভিরের ধমকে বন্যা কিছুটা কেঁপে উঠল। তানভির সহসা কৌতুক স্বরে বলল, “আরে মজা করছিলাম। চলো, তোমাকে এককাপ চা খাইয়ে রিক্সায় উঠিয়ে দিচ্ছি।”

বন্যা নাক কুঁচকে বলল, “চা খাবো না, ধন্যবাদ। ” তানভির শব্দ করে হেসে বলল, “আমি তো জানতাম তোমার চা খুব পছন্দ। এখন আমি বলছি বলে খাবে না?” বন্যা কিছুটা উদ্বেল কন্ঠে শুধালো, ” আপনাকে কে বলছে? মেঘ?” ” সেটা তুমি জেনে কি করবা? খাবে কি না বলো।” বন্যা আস্তে করে বলল, “ঠিক আছে।”

অনেকটা সামনে এগিয়ে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে দুজনেই চা খেতে দাঁড়িয়েছে। আশপাশে তেমন মানুষজন নেই৷ চায়ের দোকানে ৪-৫ জন লোক চা খাচ্ছে যার মধ্যে দু’জন সিগারেট টানছে। বন্যা গোল গোল চোখে সেই লোকদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের হাবভাব দেখে বন্যার ভ্রু যুগল আরও কুঁচকে আসে। তানভির সে দৃশ্য দেখে বলল, “তুমি বরং এ পাশে দাঁড়াও তাহলে ধোঁয়া আসবে না। ” বন্যা অতর্কিতে তানভিরের পানে তাকালো৷ কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলো৷ তানভির তপ্ত স্বরে বলল,

“কিছু বলবে?” বন্যা এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে না করলো।তানভির পুনরায় প্রশ্ন করল, ” তুমি কি কোনো কারণে আপসেট? ” বন্যা চোখ তুলে তাকালো তবে কিছু বললো না। বন্যা রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়ানো আর তানভির রাস্তার পাশে দাঁড়ানো। এদিকে সচরাচর গাড়ি চলাচল করে না। হঠাৎ দু একটা গাড়ি আসে। বন্যার সঙ্গে সরাসরি চোখাচোখি হতেই তানভির বন্যার মাদকের ন্যায় চোখে গহীনে ডুবে গেছে। আশপাশ ভুলে নিরেট দৃষ্টিতে বন্যাকে দেখছে। আচমকা বন্যা এগিয়ে এসে তানভিরের পেট বরাবর শার্ট আঁকড়ে ধরে শক্ত করে টান দিতেই তানভির বেসামাল হয়ে বন্যার সঙ্গে ধাক্কা খেলো। তানভিরের ঘোর কাটতেই খেয়াল করলো একটা পিক-আপ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে তানভিরের পাশ কেটে স্প্রীডে চলে গেছে। তানভির সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে দেখলো। এদিকে বন্যার দু-হাত এখনও তানভিরের পেটে। কয়েক মুহুর্তে তানভির স্বাভাবিক হলো, বন্যার স্পর্শ অনুভব করা মাত্রই তানভিরের সারা শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে। নিজেকে সামলে তানভির সঙ্গে সঙ্গে সরে দাঁড়িয়েছে। বন্যা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

” আপনাকে এতবার ডাকলাম। কথা কানে যায় নি?” তানভির বন্যার ক্রোধিত চোখ মুখ দেখে মৃদু হাসলো। তানভিরের মস্তিষ্ক এখনও বন্যার স্পর্শে অনুভবে মেতে আছে। কি হয়েছে বা কি হতে যাচ্ছিলো এসবে তানভিরের বিশেষ মনোযোগ নেই। তানভিরের ঠোঁটে হাসি দেখে বন্যার মেজাজ আরও বেশি খারাপ হলো। রাগে কটমট করে বলল, ” আপনি হাসতেছেন? এখন যদি গাড়িটা আপনার উপর দিয়ে যেতো। তখন কি হতো?” তানভির মৃদুস্বরে বলল,

” জানি না। ” বন্যা ফের বলে উঠল, ” রাস্তাঘাটে এভাবেই চলাফেরা করেন?” তানভির কপাল গুটিয়ে প্রশ্ন করলো, “কিভাবে চলাফেরা করি?” “অসাবধানতায়। ” “ওহ।” বন্যা ফোঁস করে উঠলো, “ওহ কি? আপনার কিছু একটা হয়ে গেলে বাসার অবস্থা কি হতো একবার ভেবেছেন?” তানভির কপাল কুঁচকে বলল, ” কি হতো?”

তানভিরের দুষ্টামি বুঝতে পেরে বন্যা রাগে আরও বেশি ফুঁসছে। রাগের কারণে বন্যার ঠোঁট দুটা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ সরু হয়ে গেছে। গোলাপী লিপস্টিকে সরু ওষ্ঠদ্বয়ে তানভিরের নজর স্থির হয়ে আছে। বন্যা রাগে একের পর এক কথা বলছে। তানভির অবাক লোচনে শুধু ঠোঁটেই চেয়ে আছে। বন্যা অকস্মাৎ বলে উঠল, “আমি এখনই মেঘকে কল দিয়ে সব বলব ।” মেঘের নাম শুনে তানভিরের এবার টনক নড়ে উঠলো। তৎক্ষনাৎ বলল, “প্লিজ, বনুকে কিছু বলো না।” বন্যা ভারী কন্ঠে বলল,

” আপনি কতটা কেয়ারলেস এটা তো ওর জানা দরকার। আমি এখনি কল দিচ্ছি। ” বন্যা মেঘকে কল দেয়ার জন্য নাম্বার বের করতে লাগলো৷ তানভির বন্যার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজের পকেটে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” আর যাই করো সমস্যা নেই কিন্তু বনুকে আজকের ঘটনা বলো না, প্লিজ।” “কোনো? ” তানভির মনে মনে বিড়বিড় করল, ” ভাইয়া যদি জানতে পারে আমার জন্য বনু কান্না করছে, তাহলে সবার রাগ আমার একার উপর ঝাড়বে। ওমা আমি নাই!”

তানভির ঢোক গিলে উষ্ণ স্বরে বলল, ” বনুকে বললে বাসার সবাই জেনে যাবে। বনু কান্নাকাটি করে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলবে। বাসার মানুষের বকাও খেতে হবে। ” বন্যা চাপা স্বরে বলল, “মেঘকে খুব ভালোবাসেন তাই না?” তানভির কপাল কুঁচকে মৃদু হেসে জবাব দিল, ” হ্যাঁ খুব ভালোবাসি। ” তানভির মনে মনে আওড়াল, “বনুর বেস্ট ফ্রেন্ডকেও খুব ভালোবাসি। ” বন্যা ধীর কন্ঠে বলল,

“মেঘও আপনাকে অনেক ভালোবাসে। ওর জন্য আর বাসার সবার জন্য হলেও একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। আপনার একটু উদাসীনতায় পুরো পরিবারকে কাঁদতে হবে। তাই প্লিজ, সাবধানে চলাফেরা করবেন।” তানভির নেশাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল, “ইনশাআল্লাহ, চেষ্টা করবো।” চায়ের দোকানের মামা কোথায় চলে গেছিলেন। এতক্ষণে কোথা থেকে এসেই জিজ্ঞেস করলেন, “মামা, আপনাদের কি চা দিবো?” তানভির উচ্চ স্বরে বলল, “একটা আদা চা আরেকটা লেবু চা। লেবু চা তে চিনি একটু বেশি দিবেন।” বন্যা অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “আপনি কিভাবে জানেন আমি লেবু চা খাই আর চিনি বেশি খাই?” তানভির আড়চোখে আকাশের পানে তাকিয়ে অকস্মাৎ বলে উঠল, “ঠিকই তো। আমি কিভাবে জানি?”

বন্যা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “প্রশ্ন টা আমি আপনাকে করেছি।” তানভির মেকি স্বরে বলল, “উত্তর ভাবতে সময় দিবে তো নাকি ?” বন্যা তানভিরের হাবভাব দেখে প্রখর তপ্ত স্বরে বলল, “থাক, আর উত্তর দিতে হবে না।” “বাঁচা গেলো।” বন্যা সূক্ষ্ম নেত্রে তাকালো ততক্ষণে তানভির চা আনতে চলে গেছে। চা খেতে খেতে বন্যা বেশ কয়েকবার তানভিরের দিকে তাকিয়েছে। তানভির সেটা বুঝতে পেরে আগে থেকেই সাবধান হয়ে গেছে। চা খাওয়া শেষে চায়ের বিল দিয়ে কিছুটা সামনে গিয়ে বন্যাকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিল। যাওয়ার আগে পকেট থেকে বন্যার ফোনটা বের করে দিতে দিতে আবারও বলল,

“প্লিজ, বনুকে কিছু বলো না।” তানভির আবারও সোহাগদের কাছে গেল। খান বাড়িতে আজ মেঘ আর মীম হৈ-হুল্লোড়ে মেতেছে। গতকালই মেঘদের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। প্র্যাক্টিকেল এখনও বাকি৷ তবে প্র্যাক্টিকেল নিয়ে মেঘের তেমন কোনো টেনশন নেই। কারণ তামিম আর মিনহাজ দু’জনে মেঘ আর বন্যার প্র্যাক্টিকেলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছে। যদিও দায়িত্বটা আবিরের থেকে মাফ পাওয়ার জন্যই নিয়েছে। মেঘ, বন্যা সেসব কিছু জানে না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার খুশিতে মেঘ আজ রাতের বেলা বাসার মানুষদের রান্না করে খাওয়াবে। রান্না ভালো হলে পরবর্তীতে অন্য একদিন ফুপ্পিদেরও দাওয়াত দিবে। বিকেলের দিকে মেঘ আবিরের নাম্বারে কল দিল। আবির কল রিসিভ করে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

” বলুন।” মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আপনি আমাকে সবসময় আপনি বলে সম্বোধন করেন কেনো?” “ভালো লাগে তাই। ” মেঘ চাপা স্বরে বলল, ” সেসব বাদ দেন। রাতে কি খাবেন বলুন?” মেঘের কথা শুনে আবির নিঃশব্দে হেসে রাকিবের দিকে তাকালো। রাকিব আস্তে করে বলল, “কি হয়েছে?”

আবির ফোনটা একটু দূরে সরিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ” নিজেকে আজ বিবাহিত মনে হচ্ছে।” পুনরায় ফোন কানে ধরে বলল, ” যা রান্না হবে তাই খাবো।” মেঘ কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ” আপনি যা বলবেন তাই করবো।” “আপনি রান্না করবেন?” “জ্বি স্যার।” আবির ভারী কন্ঠে বলল,

” রান্না করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাসায় আসার সময় সবার জন্য খাবার নিয়ে আসবো। আপনি সবাইকে দিয়ে দিয়েন।” মেঘ রাগী স্বরে বলল, “নাহ। আমি রান্না করবো।” আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ” শরীরে যদি আবার তেল পড়ে?” মেঘ অদম্য কন্ঠে বলে উঠল, ” কিছু হবে না। আপনি শুধু বলুন কি খাবেন?” “পোলাও। ” “আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে আসবেন। আল্লাহ হাফেজ।” “আল্লাহ হাফেজ। ”

কল কাটতেই রাকিব বলল, ” আমি একটা বিষয় সবসময় খেয়াল করি। তুই মেঘকে রান্না করতে দিতেই চাস না। সমস্যা কি তোর? তোর বউ কালো হয়ে যাবে এই ভয়ে রান্না ঘরে ঢুকতে দেস না?” আবির গুরুভার কন্ঠে বলল, ” ও আমার মানে সম্পূর্ণ আমার। ফর্সা হলেও আমার, কালো হলেও আমার ই থাকবে। ও সবেতেই আমার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাসার মানুষ। বিয়ের দেয়ার ভয়ে আমি আগে থেকেই ও কে রান্না করতে দিতাম না। অথচ চাচ্চু সেই বিয়ে দিতেই উঠেপড়ে লেগেছে। এখন একটু শান্ত আছে ঠিকই তবে যদি একবার রান্নাবান্না শিখে ফেলে তাহলে আর ওনাকে আটকানো যাবে না।”

রাকিব ঠাট্টার স্বরে বলল, “ভালোই হবে, মেঘের বিয়েতে আবির দিওয়ানা। বাবুর বাবা হতে গিয়ে হয়ে যাবে মামা।” আবির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ” নিজের মুখ টা বন্ধ রাখ শা*লা, নয়তো তোর মা*থা ফা*টিয়ে আমি চলে যাবো থা*না। ” রাকিব মৃদুস্বরে বলল, “আমি কি তোর শা*লা?” ” তুই শা*লা না হলেও তোর কর্মকাণ্ড শা*লার মতোই। ভুলেও যদি উল্টাপাল্টা কথা বলবি তাহলে তোর খবর আছে। ”

রাকিব হাসতে হাসতে বলল, ” আমি ভাবছি মেঘের বিয়েতে…. ” আবির কপাল কুঁচকে রক্তাভ চোখে তাকাতেই রাকিব থতমত খেয়ে বলল, “তোর আর মেঘের বিযের কথায় বলছি আমি।” “কিছু বলতে হবে না। আমি বাসায় চলে যাচ্ছি, তুই সামলে নিস।” “আচ্ছা।”

আবির মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পর বাসায় আসছে। রান্নাঘরে মেঘ আর মীম রান্না করছে। বাড়ির তিন কর্তী সোফায় বসে চা খাচ্ছেন আর গল্প করছেন। আবির বাসায় ঢুকে এই দৃশ্য দেখে ভ্রু কুঁচকালো। কিছু বলতে গিলেও বলল না। নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর নিচে আসছে। আবিরকে দেখেই মালিহা খান বললেন, “কিরে আবির, কফি করে দিব?” “নাহ তোমরা গল্প করো। আমি করছি।”

“তুই রান্নাঘরে যাবি?” আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কেনো? রান্নাঘরে যাওয়া কি বারণ?” “আমাদের জন্য বারণ৷ মেঘ ফোন নিয়ে রান্না করতে গেছে। আমাদের আশেপাশে ভিড়তেও নিষেধ করেছে। দেখ তোকে অনুমতি দেয় কি না।” আবির রান্নাঘরের কাছে যেতেই মেঘ চেঁচিয়ে উঠলো, “আপনি রান্নাঘরে আসবেন না।” “কেনো?”

“আপনার কি লাগবে বলুন। আজ রান্নাঘরের দায়িত্ব আমার। ” আবির উষ্ণ স্বরে বলল, “আর তোকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার। ” আবিরের কথা শুনে মেঘের থেকেও বেশি মীম লজ্জা পেয়েছে। দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে থাকতে চাই না সে। তাই মাথা নিচু করে চুপচাপ বেড়িয়ে যাচ্ছে। আবির রাগী স্বরে বলল, “তুই কোথায় যাচ্ছিস?” মীম আস্তে করে বলল, “রেস্ট নিয়ে আসতেছি।”

আবির গ্যাসে গরম পানি বসিয়ে মেঘের রান্না গুলো চেক করছে। পোলাও, ডিম ভুনা ছাড়াও আরও ২-৩ আইটেম অলরেডি করে ফেলেছে। রান্নাঘরের এক পাশে রান্নার ভিডিও চলছে। আবির সবগুলো একটু একটু করে টেস্ট করছে আদোও খাওয়ার যোগ্য হয়েছে কি না বুঝার জন্য। মেঘকে রান্না করতে দিতে চাই না ঠিকই কিন্তু রান্না করার পর সেই রান্না কেউ মুখে তুলতে না পারলে এটাও আবিরের জন্য অপমানজনক বিষয়। সবগুলো চেক করে আবির টুকটাক বলে দিচ্ছে, পরিশেষে পোলাও মুখে দিয়ে আবির থ হয়ে গেছে। মেঘও আহাম্মকের মতো আবিরকে দেখছে। আবির কোনোরকমে গিলে ধীর কন্ঠে শুধালো,

“লবণ দেস নি?” “নাহ।” “কেনো? রেসিপিতে লবণ দেয় নি তারা?” “দিয়েছিল।” “তাহলে তুই দেস নি কেনো?” মেঘ উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো, ” ভাতে কেউ লবণ দেয়?”

মেঘের কথা শুনে আবির বেকুব বনে গেল। এমন সময় আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান বাসায় আসছেন। আবির তাড়াতাড়ি কফি করে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এসে মালিহা খানকে ইশারায় রান্নাঘরে যেতে বললো। মালিহা খান গেলেও মেঘের জেদের কারণে তিনি বিশেষ কোনো সাহায্য করতে পারেন নি। ঘন্টাখানেক পর সবাই খাবার টেবিলে বসেছে। মেঘ আজ নিজের হাতে সবাইকে খেতে দিচ্ছে। মালিহা খান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে দিচ্ছেন কোনটাতে লবণ কম হয়েছে, কোনটাতে বেশি হয়েছে। আবির আর তানভির মিটিমিটি হাসছে। মোজাম্মেল খানের নজরে পড়তেই ফোঁস করে উঠলেন,

” এত হাসাহাসি করো না। তোমরা যাও, এতগুলো আইটেম রান্না করে নিয়ে আসো তারপর দেখি কেমন হয়।” তানভির ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “আমরা সেজন্য হাসছি না। আপনি যে এ অবস্থায় বনুকে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবেন। তারজন্য হাসছি। ” মোজাম্মেল খান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন, “এমন বাড়িতেই মেয়ে বিয়ে দিব যেখানে আমার মেয়েকে রাঁধুনি নয় রাজরানী হয়ে থাকবে।” তানভির মাথা নিচু করে মনে মনে আওড়াল,

“আর সেটা এই খান বাড়ি। এখানেই আমার বোন রাজরানী হয়ে থাকবে। অথচ আপনি বুঝতে পারছেন না।” রাত ১০ টার পরে মেঘ আবার রান্না করতে গেছে। এবার আর কোনো রেসিপি চেষ্টা করে নি। সবার জন্য নুডলস রান্না করে মীম, তানভির কে রুমে দিয়ে কিছুটা আবিরের জন্য নিয়ে গেছে আর বাকিটা বাসার সবার জন্য রেখে গেছে। মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল, “আসবো?” আবির ওয়ারড্রবে জামাকাপড় রাখছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘের অন্ধকারাচ্ছন্ন চেহারা দেখে থমকে দাঁড়ালো। হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে ?”

মেঘ চিবুক নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ” আমার রান্না ভালো হয় নি হয়তো পেট ভরে নি। তাই নুডলস নিয়ে আসছি।” আবির মৃদু হেসে বলল, ” বি*ষ নিহিত জেনেও প্রতিনিয়ত আমরা কত কি খাচ্ছি সেখানে আপনার লবণ কম, মসলা বেশি খাবার আর এমন কি” মেঘ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, “আমি কিছুই ঠিকমতো পারি না। ” আবির কোমল কন্ঠে ডাকলো, “ম্যাম” মেঘ আস্তে করে বলল, “হুম।”

“আপনাকে আগেও বলেছি আজ আবারও বলছি রান্নার বিষয় নিয়ে ভুলেও মন খারাপ করবেন না। পৃথিবীতে কেউ ই পারফেক্ট হয় না, মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়েই সারা জীবন কাটাতে হয়। ” মেঘ মুখ ফুলিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির আবারও বলল, “আপনার জন্য দুটা শার্ট রেখেছিলাম, দেয়া হয় নি আর। পুরাতন শার্ট নিবেন নাকি নতুন কিনে দিব?” আবির ইস্ত্রি করা দুটা শার্ট বের করে মেঘের দিকে এগিয়ে দিল। একটা সাদা আরেকটা কফি কালার। মেঘ শার্ট দুটা দেখে সহসা আবিরের দিকে তাকালো। আবিরের পড়নেও শুভ্র রঙের একটা শার্ট। মেঘ মনে মনে সাহস অর্জন করে হঠাৎ বলে ফেলল,

” পুরাতন ই নিব কিন্তু আমি এই সাদা শার্ট নিব না। আপনার পড়নের টা নিব।” আবির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা, ঐ ২ টা আপাতত নিয়ে যান। কালকে এটা ধৌয়ে তারপর দিয়ে আসবো নে।” মেঘ শ্বাস ছেড়ে নিরেট কন্ঠে বলল, “শার্ট আমি ধৌয়তে পারবো। দিলে এখনি দেন নয়তো লাগবে না। ” আবির সঙ্গে সঙ্গে শার্ট খুলে একটা টিশার্ট পড়ে সাদা শার্ট মেঘকে দিয়ে দিলো। মেঘ তিনটা শার্ট নিয়ে যেতে যেতে বলল,

“নুডলস টা খেয়ে নিয়েন।” রুমে এসেই দরজা বন্ধ করে আবিরের পড়নের সাদা শার্টটা মেঘ জামার উপর দিয়েই পড়ে নিয়েছে। শার্ট লম্বায় হাঁটুর কিছুটা উপর পর্যন্ত পৌঁছেছে তবে সেসবে মেঘের মনোযোগ নেই। মেঘ চোখ বন্ধ করে আপন মনে আবিরের গায়ের গন্ধ উপলব্ধি করছে। কল্পনাতে আবিরকে নিয়ে শতাব্দী পেরিয়ে যাচ্ছে। অজানা অনুভূতি মেঘের মনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে।

মেঘ পুরো ঘরে ছুটোছুটি করে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। লজ্জায় মেঘের নাক মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। বার বার হাত দিয়ে মুখ ডাকছে আবার আঙুল ফাঁকা করে নিজেকে দেখছে। অকস্মাৎ আবির ভাইয়ের মতো হাতা ফোল্ড করতে শুরু করলো। আবিরের মতো সুন্দর না হলেও মেঘ সেভাবেই কোমড়ে হাত রেখে ফ্যাশন করছে, একটু পরপর শার্টের গন্ধ শুঁকছে। প্রায় ২০ মিনিট পর মেঘ বিছানায় শুয়ে দুচোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো।