প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে | ভালোবাসার স্বীকৃতি
আবিরের আদুরে ভঙ্গির কথোপকথন শুনে মেঘ লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে মুখ দিয়ে আর কোনো কথায় বের হচ্ছে না। মেঘের দুগাল লাল হয়ে গেছে, নাকের ডগায় ঘাম জমে চিকচিক করছে। অডিও কলে আর মেসেজে মেঘের কথার রাজত্ব চললেও ভিডিও কলে আবিরের সাথে কথা বলতে মেঘের হিমসিম খেতে হয়। গত দেড় বছরে আবির যতটা ভদ্র থাকার চেষ্টা করেছে, এই দুই তিনমাসে ভদ্রতার সেই মুখোশ সরে গেছে। সব বিধিনিষেধ ভুলে মেঘকে আপন করার এক বিচিত্র প্রচেষ্টা চলছে। আবিরের অব্যক্ত দৃষ্টি সর্বক্ষণ কিছু ব্যক্ত করতে চাই। আর সেই অবাঁচ্ছিত দৃষ্টিতেই মেঘ বারংবার ঘায়েল হয়। আবিরের সাথে যতবার কথা হয় কল কাটার আগে মেঘের শেষ কথা থাকে,
“I Miss You” আবিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কল কাটে প্রতিবার। মেঘের এমন কর্মকাণ্ডে নিঃশব্দে হাসা ছাড়া আবিরের আর কিছুই করার থাকে না। রাত ১১ টার দিকে তানভির বন্যার নাম্বারে কল দিল। আজ প্রথম কলটায় রিসিভ হলো। বন্যা মৃদু স্বরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম ” “ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বর কমেছে?” “কিছুটা।” ” ঔষধ খেয়েছো?” “জ্বি। আপনি খেয়েছেন?” “না।” বন্যা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠল, “এত রাত হয়ে গেছে এখনও খান নি কেনো?”
“একটা কাজে শহরের বাহিরে আসছিলাম। অনেক রাত হয়ে গেছে তেমন দোকানপাট খোলা নেই। দু-একটা খোলা আছে কিন্তু খাবারের মান তেমন ভালো না। তাই খেতে ইচ্ছে করে নি।” “সারারাত না খেয়ে থাকবেন?” ” তুমি হঠাৎ আমার খাবার নিয়ে এত চিন্তা করছো কেন? ঘটনা কি?” “আমার সামান্য জ্বর দেখেই আপনি সন্ধ্যায় যেভাবে ডাক্তার দেখাতে উতলা হয়ে গিয়েছিলেন। তখন কি আমি কিছু বলেছি?”
“এটাকে সামান্য জ্বর বলে না বন্যা৷ ১০৩-১০৪° ফা জ্বর কখনোই স্বাভাবিক না। তার থেকেও বড় কথা এত জ্বর নিয়ে তুমি ঘুরতে বের হলে কোন বিবেকে? এই তোমার ম্যাচিউরিটি?” “আমি কখন বললাম আমি ম্যাচিউর? তাছাড়া আজ না বের হলে হয়তো জীবনের সেরা মুহুর্তটা মিস করতাম। ” “মানে? কিসের সেরা মুহুর্ত?” “তেমন কিছু না তবে অনেক কিছু।” ” বনুর মতো তুমিও শুরু করো না প্লিজ। এমনিতেই খায় নি মাথা ঘুরছে তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে এখন ই বেহুঁশ হয়ে যাব। কি হয়েছে বলো, প্লিজ।” বন্যা ফিসফিস করে বলল, “আপু আসছে, বাই।”
বন্যা কল কেটে দিয়েছে। তানভির থম মেরে বসে আছে। একটু পর আবিরকে মেসেজ দিল, খানিক বাদেই আবিরের কল আসছে৷ রিসিভ করতেই আবির বলল, ” তোকে আমি একটা কাজ দিয়েছিলাম তা না করে এত রাতে কার সাথে কথা বলছিস?” তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে জানালো, ” বন্যার সাথে কথা বলছিলাম আর তোমার কাজ শেষ করেই কথা বলছি। আমি তো তোমার মতো না যে সব কাজ ফেলে বউয়ের সঙ্গে প্রেম করতে লেগে যাব। দূর! বেশি কিছু বলতেও পারি না কারণ বোনটাও আমার ই।” আবির ঠাট্টার স্বরে শুধালো,
“এত রেগে আছিস কেন? কি হয়েছে ভাই..! ” “রেগে থাকব না? একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসছি, সবকিছু ফাইনাল। তোমার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য জাস্ট কল দিয়েছি। দুমিনিটের আলাপ সেখানে তুমি আমার কল তো রিসিভ করলাই না উল্টো আমায় ব্লক করে দিলা? এখন আবার আমায় বলতে আসছো, আমি কাজ ফেলে কার সঙ্গে কথা বলি? বাহ ভাই!” আবির স্বভাব-সুলভ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“প্রেমের সময় যারা বাগড়া দেয় তারা মানুষরূপী আগাছা। বুঝলি?” “আমি আগাছা হলে তুমিও আগাছা। আমার প্রেমের সময় তুমিও বাগড়া দিয়েছো।” “একদম না। আমি একবার কল দিয়ে ওয়েটিং পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিয়েছি। আর একটা কলও দেয় নি। তুই কথা শেষ করে মেসেজ দিয়েছিস তারপর আমি কল দিয়েছি। আর তুই? আমি বার বার কল কেটে দিচ্ছিলাম তারপরও তুই কল দিয়েই যাচ্ছিলি।”
“হয়েছে হয়েছে! আমি মানছি আমি আগাছা। শুধু তুমি না, সবার জীবনেরই আগাছা আমি। বেকুবের মতো এক মেয়ের প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়ে বাসার সবার চোখে আগাছা হয়েছি, ঐ মেয়ের জন্য নিজের পড়াশোনা ধ্বংস করেছি। রাজনীতির নামে মুখোশধারী মানুষের সাথে প্রতিনিয়ত বাকবিতন্ডায় জড়াচ্ছি। এখন একজনকে মন থেকে ভালোবাসি কিন্তু তার জীবনেও আমি ভিলেন পদে আছি। আহারে! আগাছাময় জীবন আমার।”
আবির মোলায়েম কন্ঠে বেশ কিছুক্ষণ বুঝানোর চেষ্টা করলো। তানভিরের সভাপতি নির্বাচনের এক বছর কেটে গেছে। তিনবছরের কমিটি এই এক বছরেই তছনছ হয়ে গেছে। কমিটির সদস্যের ঐক্যবদ্ধ জোট ভেঙেছে আরও ৩-৪ মাস আগে। সহ সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আর সাংগঠনিক সম্পাদকদের একের পর এক দ্বন্দ্বে প্রতিনিয়ত হিমসিম খাচ্ছে তানভির। স্থানীয় নেতা সহ এমপি, মন্ত্রীরাও সমস্যা সমাধান করতে পারছেন না৷ মিটিং এ সব মেনে নিলেও সুযোগে একজন আরেকজনের মা*থা ফা*টাতে ব্যস্ত। তানভিরের সঙ্গে কারো পার্সোনাল শত্রুতা নেই ঠিকই কিন্তু চোখের সামনে নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড সহ্যও করতে পারছে না।
সেই সঙ্গে বন্যাকে নিয়ে আছে তার সুদূর চিন্তাভাবনা। বন্যার পরিবারে বন্যার বাবা সরকারি চাকরিজীবী, বড় বোনও তাই। এমনকি বন্যার আত্মীয়স্বজন বেশিরভাগ ই সরকারি চাকরিজীবী। বন্যার আপুর জন্য সরকারি চাকরিজীবী ছেলে খোঁজা হচ্ছে। সেখানে বন্যা তার বোনের থেকেও বেশি ব্রিলিয়ান্ট, দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় বন্যাকে বিয়ে করার জন্য তানভিরের বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও নেই। বন্যাদের বংশের কেউ কখনো রাজনীতি করে নি। সেখানে তানভিরদের বাসায় স্বয়ং আলী আহমদ খান এককালে এলাকার সুপরিচিত রাজনীতিবিদ ছিলেন। গ্রামের বাড়িতে এখনও অনেকে ওনাকে নেতা হিসেবেই চিনেন।
পারিবারিক ও ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে একসময় রাজনীতি ছেড়ে, গ্রামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঢাকায় চলে আসেন৷ হয়তো বাবার রক্তের টানে কলেজ জীবনে আবিরও টুকটাক রাজনীতিতে জড়িয়েছিল তবে পুরোপুরি জড়ানোর আগেই কলেজের এক স্যার আবিরকে বুঝিয়ে রাজনীতির চিন্তা ছাড়িয়ে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী করেন। আব্বু আর স্যারের কথা মেনে আবিরও রাজনীতি নিয়ে তেমন ভাবে নি। কিন্তু তানভির আবিরের মতো না, ঐ মেয়ের কারণে বাসায় যখন ঝামেলা হয়েছিল তখন ২-৩ নেতা আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খানকে বাজে কথা বলেছিলেন।
সেখান থেকেই তানভিরের ভেতর জেদ কাজ করে আর সে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজনীতি করতে না দিলে পড়াশোনা করবে না বলে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল।তখন বয়স কম ছিল আর তানভির এতটায় জেদি ছিল যে আবিরও তাকে মানাতে পারে নি তাই বাধ্য হয়ে তানভিরকে বেশ কিছু শর্ত দিয়ে আবির রাজি হয়েছিল। কয়েকবছরেই তানভিরের মন উঠে গেছে। একদিন কথায় কথায় মেঘের মুখে শুনেছে বন্যার রাজনীতি একদম পছন্দ না তাই ইদানীং তানভিরের মাথায় ভূত চেপেছে সে রাজনীতি ছেড়ে পড়াশোনা করবে, চাকরি নিয়ে বন্যাকে বিয়ে করবে। একটা সময় তানভিরের রাজনীতির জন্য আবিরকে প্রচুর বকা খেতে হয়েছিল তবে এখন সবাই মোটামুটি স্বাভাবিক।
তানভিরকে নিয়েও কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই অথচ তানভির হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এই অমার্জিত রাজনীতি আর করবে না। যেখানে এক কমিটির অন্তর্ভুক্ত সদস্যরা নৈতিকতা ভুলে একে অপরের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়াতে পারে সেই নোংরা রাজনীতিতে তানভির থাকবে না। এমপি তানভিরের সঙ্গে কথা বলে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু সে তার জেদ থেকে এক চুলও নড়বে না। আবিরকে কল দেয়ায় আবিরও নিরেট কন্ঠে বলেছিল, ” আমার ভাই যা বলবে তাই হবে। আমি আমার ভাইকে খুব ভালোবাসি।
ও যখন যা চেয়েছে আমি তাই দিয়েছি, ও রাজনীতি করতে চেয়েছে আমি তাতেও সাপোর্ট করেছি আর এখন সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতেও সাপোর্ট করবো। কারণ আমি আমার ভাইকে কারোর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে দেখতে পারবো না। অতি সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কমিটিতে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাব যে আমার ভাইয়ের উপর পরবে না তার কি গ্যারেন্টি আছে? আজ নয়তো কাল কেউ যে আমার ভাইয়ের উপর অ্যাটাক করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?”
এমপি আবিরকে বুঝাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। ওনাদের ইচ্ছে ছিল তানভিরকে সভাপতি পদে রেখে, বাকি কিছু সদস্য যুক্ত করে জেলাভিত্তিক নতুন করে কমিটি গঠন করে ফেলা। কিন্তু তানভির রাজি না থাকায় নতুন করে আবারও সবকিছু করতে হবে সেসব ভেবেই সবাই কিছুটা চিন্তিত৷ আগামী সপ্তাহে মিটিং ডাকা হয়েছে, সেদিন সবকিছু ঠিকঠাক হলে কমিটি ঠিক থাকবে না হয় অফিসিয়ালি কমিটি বাতিল করা হবে।তানভিরের সেসবে চিন্তা নেই। আর তানভিরকে ব্যস্ত রাখতে আবির ইচ্ছে করেই অফিসের কাজ সহ বেশকিছু কাজের জন্য তানভিরকে চাপে রাখছে।
দুপুর থেকে রাকিবের ফোনে রিয়া আর জান্নাত এক নাগাড়ে কল দিয়েই চলেছে। বাধ্য হয়ে ৪ টা নাগাদ রাকিব অফিস থেকে বেড়িয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল৷ রিয়া আজ সারাদিন ধরে মেঘের জন্য রান্না করেছে। সেগুলোই রাকিবকে দিয়ে পাঠাবে। রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতও বায়না ধরেছে মেঘের জন্য খাবার পাঠাবে। রাকিব এর কিছুই জানতো না। অফিস থেকে এসে এতো আয়োজন দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। কারণ জিজ্ঞেস করায় রিয়া বলেছে মেঘের আব্বু বিয়েতে রাজি সেই খুশি তাদের সামান্য আয়োজন। আবিরের আব্বু রাজি হলে বিশাল আয়োজন করবে। রিয়ার কথা শুনে রাকিব রীতিমতো আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। মেঘের আব্বু আবির-মেঘের সম্পর্কে রাজি এটা রাকিব জানে না অথচ রিয়া -জান্নাত জানে এটা ভেবেই হতাশ হচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে আবিরকে কল দিল। আবির কল রিসিভ করতেই রাকিব বলল,
” ভালোই তো। আজ শ্বশুরকে রাজি করিয়ে ফেলেছিস কাল বাপকেও রাজি করিয়ে ফেলবি। পরশু বউকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবি। এদিকে তোর যে রাকিব নামের একটা বন্ধু ছিল সেটা বেমালুম ভুলে যাবি। বন্ধুত্বের সম্পর্কও ভেঙে দিবি।” আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” ৭ বছরের দূরত্বে যে বন্ধুত্ব ভাঙে নি, ৫ মাসে সে বন্ধুত্ব কি ভাঙবে? আর শ্বশুর রাজি এটা তোকে কে বলছে?” “জান্নাত আর রিয়া বললো। তারা এই খুশিতে সারাদিন ব্যাপী রান্না করছে তোর বউকে খাওয়ানোর জন্য। ” “মানে কি এসবের?” “মানে রাখ। আগে বল তোর শ্বশুর কি আসলেই রাজি? কথা বলছিস তুই?” “তুই কি পাগল হয়ছিস? এখন কথা বললে উপায় আছে? একদিন রিয়েক্ট করেই চিন্তায় আছি, রাগে ৬ মাসের হুমকি তো দিয়েছি ঠিকই কিন্তু মানলে বিশ্বাস। কবে না সব ভুলে বিয়ের আলোচনা শুরু করে দেন। আর এখন যদি এখান থেকে আমি এই কথা তুলি দেখা যাবে কাল সকালেই মেয়ের বিয়ের জন্য তোরজোর শুরু করে দিবেন। ” “জান্নাতকে কি বলছিস তাহলে?”
“জান্নাতের সাথে মজা করছি। সে কাল ভাবির মতো আচরণ করেছে তাই আমিও দেবরের মতো দুষ্টামি করেছি৷ পুরোটা দুষ্টামি ছিল এমনটা নয় কারণ আমার শ্বশুরের এমন আচরণ আমাকেও বেশ ভাবাচ্ছে। ” “কেনো কি হয়েছে?”
” আমি রাগ করে বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে চাচ্চু অনেক শান্ত হয়ে গেছেন। মেঘের বিয়ের জন্য নিজেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন আবার নিজেই চুপ হয়ে গেছেন৷ এমন কেনো করল আমি জানি না তবে সন্দেহ করছি। এত বছর আব্বুর সাথে আমার রেগুলার কথা হতো। চাচ্চুর সাথে ৭ দিনে ১ দিন কিংবা ১৫ দিনে একদিন ২ মিনিটের জন্য কথা হতো। অথচ এবার আমি এখানে আসার পর থেকে আব্বুর থেকে বেশি চাচ্চুর সাথে কথা হচ্ছে। রেগুলার দু’বেলা করে ওনি নিজেই ফোন দেন। এমন না যে শুধু প্রজেক্টের জন্য ওনি চিন্তিত। এমনিতেই খোঁজ নেন, কি করছি, খাচ্ছি কি না ঠিকমতো, কবে ফিরব, শরীর ঠিক আছে কি আরও অনেককিছু। আগে যেসব কথা আব্বু বলতো সে সব কথা এখন চাচ্চু বলেন। ওনার এমন আচরণে মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি আসার সময় ওনার মেয়েকে সাথে নিয়ে আসছি। ওনার মেয়েকে যেন সুখে রাখি, তার সাথে যেন ভালো ব্যবহার করি সেজন্য দুবার করে ফোন দিয়ে এলার্ট করেন। ”
“ভালোই তো। ওনি রাজি থাকলে তোর টেনশন ই করতে হবে না।” আবির কন্ঠ দ্বিগুণ ভারী করে বলতে শুরু করল, “ভাই ওনাকে আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না। হতেও পারে ৬ মাসের হুমকির জন্য এখন কিছুটা শান্ত আছেন। শুনেছি আব্বুর সাথে ঝামেলা হয়েছে, তারজন্য হয়তো কিছুদিন চুপচাপ আছেন। যতদিন না বাসর করতে পারছি ততদিন পর্যন্ত আমি কাউকে বিশ্বাস করি না৷ বাসর রাতের পরদিন বলতে পারব, আমার শ্বশুর আমাকে মেনে নিয়েছে কি না!” রাকিব মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল, “রিয়া আর জান্নাত যে খুশির ঠ্যালায় এতকিছু রান্না করল এখন কি আমিই খেয়ে ফেলব এসব?” “সোজা আমাদের বাসায় নিয়ে দিয়ে আসবি। আমার বৌয়ের ভাগ থেকে একটা কিছু কমলে তোর কপালে শনি আছে। ” রাকিব মুচকি হেসে বলল,
” তুই এখনও আগের মতোই আছিস। মেঘকে নিয়ে সামান্য একটু মজা করলেও যেভাবে রিয়েক্ট করিস আমার ভয় ই হয়। যেদিন বাসায় মেঘের কথা বলবি সেদিন ঠিক কি হবে!” “কি আর হবে। আব্বুরা উল্টাপাল্টা করলে মেঘের হাত টা ধরে সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে যাব।” “মেঘ যেতে না চাইলে?” “কোলে নিয়ে চলে যাব।” ” এটায় তো চাই। মেঘকে নিয়ে সোজা আমাদের বাসায় চলে আসিস।” “সেসব পরে দেখা যাবে। এখন রাখি। বের হতে হবে। ” “আচ্ছা ঠিক আছে। ”
রাকিব আর আরিফ খাবার নিয়ে একসঙ্গে মেঘদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। গেইটের ভেতর খোলা জায়গায় মীম আর আদি ক্রিকেট খেলছিল। মেঘও এতক্ষণ এখানেই ছিল কেবল ই ভেতরে গেছে। আদি বোলিং করছে আর মীম ব্যাটিং করছে। রাকিবের হাতে সব খাবার, ভেতরে ঢুকে আদিদের খেলতে দেখে তাড়াতাড়ি চলে গেছে। পেছনে ছিল আরিফ। গেইটের ভেতরে পা রাখতেই বল এসে ঠাস করে ঠোঁটে উপর লাগছে। একটুর জন্য নাকটা বেঁচে গেছে। আরিফ ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল, মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। এদিকে মীম ব্যাট ফেলে দৌড়। আদি কি করবে বুঝতে না পেরে মেঘকে ডাকতে ছুটলো।
আরিফ চোখে অন্ধকার দেখছে, ব্যথা সহ্য করতে না পেরে এখানেই বসে পরেছে। রাকিব ভেতর থেকে আরিফকে দুবার ডেকেওছে। কিন্তু মালিহা খানের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় বেড়িয়ে এসে দেখতে পারে নি। আদি মেঘকে বলতেই মেঘ দ্রুত ছুটে আসছে। ততক্ষণে আরিফ কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু দাঁতে আর মাড়িতে চাপ খাওয়ায় রক্ত বের হচ্ছে ।
মেঘ দৌড়ে এসে আরিফকে তুলে সাপ্লাই এর কাছে নিয়ে গেছে। চোখে-মুখে পানি দিয়ে আরিফকে ভেতরে নিয়ে গেছে। মেঘ ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে ঠোঁটের উপর লাগাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা ফুলে গেছে। মীম বেশকিছুক্ষণ পর নিচে আসছে। শীতল চোখে আরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য সময় ইচ্ছেকৃত ব্যথা দিলেও মীম আজ ইচ্ছেকরে কিছু করে নি৷ মীম ভেবেছিল রাকিব ভাইয়া একায় এসেছেন তাই রাকিব ভেতরে চলে যাওয়ায় আবার খেলতে শুরু করেছিল। মীম আর আদি চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, রাকিব আরিফের পাশে সোফায় বসে আছে। আলী আহমদ খান বাসায় ফিরে আরিফের অবস্থা দেখে চিন্তিত স্বরে জানতে চাইলেন,
“কি হয়েছে তোমার?” আরিফ সত্যি কথা বলতে গিয়েও থেকে গেল। মীমের শীতল চোখদুটো আর অসহায়ের মতো চাহনি দেখে আরিফ আস্তে করে বলল, “তেমন কিছু না বড় মামা।” আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন, ” বসো। আমি আসছি।”
মীম ভয়ে আরও বেশি সিঁটিয়ে গেছে। বড় আব্বু জোর গলায় জিজ্ঞেস করলেই আরিফ বলে দিবে। বড় আব্বু জানতে পারলে ওদের যে কি হাল করবে সেই ভেবেই মীমের হাত পা কাঁপছে। কিছুক্ষণ পর তানভির আসছে। রাকিব তানভিরের সাথে কথা বলতে তানভিরের রুমে চলে গেছে। মেঘ রান্নাঘরে শরবত করছে আর মালিহা খান ওদের জন্য নাস্তা রেডি করছেন। মীম সেখান থেকে এক গ্লাস শরবত নিয়ে আরিফের কাছে গেল৷ মীম চোখ নামিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
“সরি, আমি আপনাকে সত্যি দেখি নি। হুট করে এসে ঢুকেছেন আর বলটাও সেসময় ই লেগেছে।” আরিফ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ” আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে এমন করেছো। আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি যে তুমি সবসময় আমার সাথে এমন আচরণ করো।” মীম ধীর কন্ঠে বলল, ” আপনি বিশ্বাস করুন, আমি ইচ্ছে করে এমনটা করি নি। ” “মিথ্যাবাদী মেয়ে৷ চুপ করো। বড় মামা আসলে আমি সব বলে দিব।”
মীমের এবার রাগ উঠে গেছে। হাতে থাকা গ্লাসের সবটা শরবত শেষ করে গ্লাস রাখতে রাখতে রাগান্বিত স্বরে বলে, “আপনি আমায় ভয় দেখাচ্ছেন? কি ভাবছেন আমি খুব ভীতু? একদম না। আমি কাউকে ভয় পায় না। আমার কারণে ব্যথা পেয়েছেন তাই মানবতার খাতিরে সরি বলতে আসছিলাম। এখন বুঝতে পারছি আপনি এই সরির যোগ্য ই না। ”
মীম রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেছে। আরিফ আর রাকিব নাস্তা করে সন্ধ্যার আগে আগে বেরিয়েছে। এরমধ্যে রাকিবের ফোন দিয়ে রিয়ার সাথে ভিডিও কলে কথাও বলেছে মেঘ। সন্ধ্যা পর আবিরকে একটা ছেলের ছবি পাঠিয়ে মেঘ মেসেজ দিয়েছে, “ছেলেটা কেমন?” “ভালো। কে?”
মেঘ পরপর একটা বিয়ের কার্ডের ছবি পাঠিয়ে মেসেজ দিল, “আগামী শুক্রবার বিয়ে। আপনার দাওয়াত রইলো। চলে আসবেন। ” “মানে? কার বিয়ে?” মেঘ মুচকি হেসে লিখল, “আমার।” “মা*র্ডার করে ফেলবো।” মেঘ কতগুলোর হাসির ইমোজি পাঠিয়ে লিখল,
“মা*র্ডার করতে হলেও আপনাকে আমার সামনে আসতে হবে। বিয়ের দিন দেখা হচ্ছে তাহলে।” আবির এবার কল দিল। মেঘ ভয়ে কল রিসিভ করছে না কারণ কল রিসিভ করলেই বকা খেতে হবে। তিনবারের মাথায় বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করল। আবির রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা কে?” “বয়ফ্রেন্ড।” “কার?” “আমা…” “রাগাবি না আমায়। ছেলেটা কে বল।” “বললাম তো বয়ফ্রেন্ড। ” “কার?” “আমার বান্ধবী মায়ার বয়ফ্রেন্ড। ”
” কার্ড কার?” “মায়ার বিয়ে শুক্রবারে। সেটার ই কার্ড।” ” বার বার নিজের কথা বলছিলি কেনো?” ” আমার বিয়ের কথা শুনে কতটা খুশি হোন তাই দেখছিলাম।” আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল, “বিয়ে করার খুব ইচ্ছে তোর?” “হ্যাঁ। অনেক ইচ্ছে। বিয়ে করলে সাজতে পারবো, ছবি তুলতে পারবো, অনেকগুলো শাড়ি হবে, ড্রেস হবে, কত কত গিফট পাবো। আহ! সবগুলো নিয়ে পালায় যাব।” “মানে? কোথায় পালাবি?” মেঘ ফিসফিস করে বলল,
“আমি তো বিয়ে করবো শুধু গিফট গুলোর জন্য। যা যা পাবো সব নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাব।” “বাহ! অসাধারণ চিন্তাভাবনা আপনার। টাকা পাঠায় বিয়ের শপিং করতে করতে রুম ভরে ফেলুন তবুও মানুষের গিফটের আশায় বসে থাকিয়েন না। ” “আপনি বুঝতে পারছেন না। বিয়ের জিনিসপত্র নিয়ে পালানোর মজায় আলাদা। ” আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বিড়বিড় করল, ” জিনিসপত্র না নিলেও আপনাকে নিয়ে আমি পালাবো, এটা নিশ্চিত। ” আবির কিছু বলছে না দেখে মেঘ মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“একটা কথা বলি?” “হুমমম।” ” বলছিলাম… না থাক।” “কি হয়েছে? বিয়েতে যেতে চাচ্ছিস? ” মেঘ চোখ বড় করে ভীত কন্ঠে বলল, ” আসলে মায়া খুব জোর করছে। না করে দিব?” “না করতে হবে না৷ যাস সমস্যা নেই।আর কে কে যাবে?” “বন্যা ভা, মানে বন্যা, আমি, মীম, আর পাখি। তানভির ভাইয়া যেতে চাইলে যাবে। ভাইয়াকে আর আপনাকেও দাওয়াত দিয়েছে। ”
“সে আমাকে চিনে?” “হুম।” “আচ্ছা। যেখানেই যান সাবধানে থাকবেন।” “জ্বি অবশ্যই। আল্লাহ হাফেজ।” শুক্রবার মীম, মেঘ, বন্যাকে নিয়ে বিয়ে খেতে গেছে। পাখি আলাদাভাবে ওর হাসবেন্ডের সাথে গিয়েছে। মেঘ তানভিরকে যেতে বলেছিল এমনকি মায়া নিজেও ফোন দিয়ে তানভিরকে বলেছে কিন্তু তানভির যেতে রাজি হয় নি। ছোট বোনের বান্ধবীর বিয়েতে যাওয়াটা তানভিরের কাছে কেমন যেন লাগে। পাখির বিয়েতেও তানভির যায় নি৷ মেঘ, মীম আর বন্যা বিয়ে বাড়ি থেকে খাওয়াদাওয়া করে ঘুরে ফিরে বন্যাকে বাসায় দিয়ে সন্ধ্যার দিকে বাসায় পৌঁছেছে। আজ বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম। আবির যাওয়ার এতদিন পর তিন ভাই একসঙ্গে বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন। তিনভাই সোফায় বসে চা খাচ্ছেন আর গল্প করছেন৷ মেঘ আর মীম একসঙ্গে সালাম দিল। মোজাম্মেল খান উঠে গিয়ে দু’জনের মাথায় হাত বুলিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে শুধালেন,
“কেমন আছিস তোরা?” “আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ তোদের জন্য জামা নিয়ে আসছি। দেখ পছন্দ হয় কি না।” মেঘ আর মীম জামা পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে রুমে চলে গেছে। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর নিচে এসে সবার সঙ্গে গল্প করতে বসেছে। গল্প কিছুই না। ওনারা কথা বলছেন মেঘ আর মীম বসে বসে শুনছে। তানভির ছাড়া এখানে সবাই উপস্থিত আছে৷ কিছুক্ষণ বাদে তানভিরও নিচে আসছে। অনেকদিন পর ভাইদের পেয়ে আলী আহমদ খান মন খুলে কথা বলছেন৷ মোজাম্মেল খান তানভিরের উদ্দেশ্যে শান্ত কন্ঠে শুধালেন,
“শুনলাম তুমি নাকি রাজনীতি করবে না?” “জ্বি। ” “হঠাৎ এই চিন্তা মাথায় ঢুকলো কিভাবে?” “এমনিতেই। ” মোজাম্মেল খান এবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
“লক্ষ্য স্থির না করলে জীবনেও কিছু করতে পারবে না। এইযে ভাই ভাই করো, ভাই এর থেকে কিছু তো শিখতে পারো। আমাদের কোম্পানির বেশিরভাগ দায়িত্ব একা সামলিয়েও নিজের কোম্পানি দাঁড় করে ফেলেছে। শুধু তাই নয় এই যে গত দুইমাস রাজশাহী আর চট্টগ্রাম ছিলাম। আমার তেমন কোনো কাজ ই করতে হয় নি। আবির অলরেডি সবকিছু গুছিয়ে রেখে গেছে। এমনকি ওখানে থেকেও প্রতিনিয়ত এখানের খোঁজ নিচ্ছে। আর তুমি কি করছো? একবার পড়াশোনা ছেড়ে দিছো, আবিরের কথায় এখনও নামমাত্র পড়াশোনা করছো, হুট করে রাজনীতির ভূত চাপছে মাথায় এখন আবার বলছো রাজনীতি করবা না। তুমি আসতে কি চাও? কি করবা জীবনে? এমন করলে কোনো মেয়ের বাবা তোমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে?” তানভির মনে মনে বিড়বিড় করছে,
” কোনো মেয়ের প্রয়োজন নেই আমার। শুধু বন্যা হলেই হবে। আমি পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি নিয়ে বন্যাকে বিয়ে করবো।” কিন্তু মুখ ফোটে কিছুই বলতে পারলো না। মোজাম্মেল খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ” যদি কিছু করতে না পারো কাল থেকে আমাদের অফিসেই যেও। বাবা-চাচার ব্যবসা যেহেতু আছে সেটার ই হাল ধরো। ”
আব্বুর কথা বলার ধরন মেঘের একদম সুবিধা লাগছে না। মেঘ তানভিরকে এক পলক দেখে নিল। তানভির মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আব্বু, বড় আব্বুর সামনে কথা বলার স্বভাব আবির, তানভির কারোরই নেই। মেঘ কপট রাগী স্বরে বলল, “ভাইয়া অফিসে যাবে না। পড়াশোনা করে চাকরি নিবে।” মোজাম্মেল খান মেকি স্বরে বললেন, “তোমার ভাই করবে চাকরি! ”
মেঘের মন খারাপ হয়ে গেছে। তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের উপর কনফিডেন্স নিয়ে বন্যাকে প্রপোজ করেছে মেঘ । বন্যার ইচ্ছা অনিচ্ছা সবটায় মেঘ জানে। বন্যার আব্বু স্ট্রং মেন্টালিটির মানুষ। ওনি যদি একবার মন স্থির করেন চাকরিজীবী ছাড়া মেয়ে বিয়ে দিব না তাহলে আর কোনোদিন ওনাকে রাজি করানো সম্ভব না। তাই আগে থেকেই ভাইকে প্রস্তুত করতে হবে। মেঘ তানভিরের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
” ভাইয়া চাকরিই করবে। ভাইয়াকে কেউ কিছু বলবা না। ভাইয়া ব্যবসা করবে না, চাকরিই করবে।” তানভির বিষ্ময় চোখে মেঘের দিকে চেয়ে আছে। মেঘ ফোপাঁতে ফোপাঁতে রুমে চলে গেছে। মনের বিরুদ্ধে কিছু ঘটলেই অভিমানী মেঘের বুক খুঁড়ে কান্না আসে। মোজাম্মেল খান তানভির এর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, “তোমাকে নিয়ে ওরা তোমার থেকেও বেশি কনফিডেন্ট। অথচ তুমি কি দাম দিচ্ছো? আবির নিজের কারণে আজ পর্যন্ত যতবার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি তোমার জন্য দাঁড়িয়েছে। আমার এই টুকু মেয়েটা পর্যন্ত তোমার জন্য কান্না করছে। তুমি কি এগুলো বুঝো? তোমার কি উচিত না ওদের মুখে একটু হাসি ফুটানো? ”
আলী আহমদ খান কোমল কন্ঠে বললেন, “বাদ দে। বাসায় ফিরে ছেলেটাকে না বকলে কি তোর শান্তি লাগে না?” মোজাম্মেল খান চিন্তিত স্বরে বললেন, ” তোমার তো চিন্তা নাই। একমাত্র ছেলে তাও আবার প্রতিষ্ঠিত। ” “আবির কি তোর ছেলে না?” “আবির আমার ছেলের মতো কিন্তু তানভির আমার ছেলে। ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাকেই ভাবতে হবে।” আলী আহমদ খান হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “ছেলেমেয়েদের মাঝে বিবাদ সৃষ্টি করিস না। আবির, তানভির, মেঘ, মীম,আদি প্রত্যেকে আমাদের সন্তান। কেউ কারোর থেকে বেশি আদরের না, সবাই সমান।”
বাকবিতন্ডা চললো বেশকিছুক্ষণ।আলী আহমদ খান তানভিরকে রুমে চলে যেতে বলেছেন।। এদিকে মেঘ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছে। তানভির ডাকতে এসে ঘুমাচ্ছে দেখে চলে গেছে, আবিরকেও জানিয়ে দিয়েছে। রাত ১.৩০ নাগাদ মেঘের ফোন ভাইব্রেশন হচ্ছে। দুবার বাজতেই মেঘ ঘুমের মধ্যে কল রিসিভ করল। অপর পাশ থেকে আবিরের আতঙ্কিত কন্ঠস্বর আসলো, “মেঘ”
“এই মেঘ, তুই ঠিক আছিস?” আবিরের গলা কাঁপছে, কন্ঠস্বর ভেজা। মেঘ থতমত খেয়ে বলল, “হ্যাঁ। আপনার কি হয়েছে?” আবির কথা বলতে পারছে না৷ চাপা কান্নার শব্দ আসছে। মেঘ শুয়া থেকে উঠে বসে উদ্বিগ্ন কন্ঠে ডাকল, “আবির ভাই। ” একটু থেমে আবারও শুধালো, “কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেনো?”
আবির কিছু না বলে কল কেটে দিয়েছে। মেঘ দ্রুত ওয়াশরুম থেকে মুখ ধৌয়ে এসে নেট অন করে তাড়াতাড়ি আবিরকে ভিডিও কল দিল। খানিক বাদে আবির কল রিসিভ করল। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে আবিরের রক্তাভ চোখে চোখ পড়তেই মেঘের শরীর কম্পিত হলো। ফ্যাকাশে চোহারা, গালে পানির দাগ, চোখের নিচ ভিজে আছে এখনও। লাইটের আলোতে চিক চিক করছে। মেঘ আর্তনাদ করে উঠল,
“কি হয়েছে আপনার?” “জানি না।” “ঘুমাইছিলেন?” “হুমম।” “বাজে স্বপ্ন দেখেছেন?” “হুমমমম।” “ভয় পাইছেন?” আবির ভ্রু কুঁচকে মেঘের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে উত্তর দিল,
“আর একটু হলে আত্মা টা বেড়িয়ে যেত।” মেঘ নির্বোধের মতো আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ঠোঁট বেঁকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ” আপনি না খুব সাহসী। এত ভয় পেলে হবে?” আবির চোখ মুখে রাশভারি কন্ঠে জবাব দিল, ” পৃথিবীর সবার কাছে আমি সাহসী হলেও আমার মন জানে একজনের জন্য আমার হৃদপিণ্ড ঠিক কতটা দূর্বল। তার কিছু হলে আমি সত্যি ম*রে যাব।”
পর্ব - ৬৭ (২)
আবিরের নিগূঢ় আঁখি যুগলে অসহায়ত্বের ছাপ। মেঘ অভিনিবিষ্টের ন্যায় আবিরের জলসিক্ত নয়নের পানে তাকিয়ে আছে। হৃদপিণ্ডের তীব্র কম্পনে মেঘের গায়ের রক্ত প্রবল বেগে টগবগ করছে। আবিরের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে, অনবরত তিরতির করে ঠোঁট কাঁপছে। মাথা থেকে ঘামের রেখা কপালের পাশ বেয়ে গড়িয়ে পরছে। আবিরের শীতল দুচোখ মেঘের অভিমুখে। মেঘ আনমনে কতকিছু ভেবে হঠাৎ পল্লব ঝাপ্টে প্রশ্ন করল,
“কি স্বপ্ন দেখেছেন?” সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে মেঘের প্রশ্ন শুনে নড়ে উঠল আবির তবে তখনও গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। থমথমে গলায় উত্তর দিল, ” দুঃস্বপ্নের কথা বলতে নেই। আর আমি ম*রে গেলেও এই স্বপ্ন সত্যি হতে দিব না। ” মেঘ ঠোঁট উল্টে চোখ গোল গোল করে অসহায় মুখ করে চেয়ে আছে। আবির পরক্ষণেই বলে উঠল, “আচ্ছা শুন” “জ্বি। ”
“তোর শরীর কেমন এখন?” “আলহামদুলিল্লাহ ভালো।” “এখনও শ্বাসকষ্ট হয়? বা অন্য কোনো সমস্যা? ” “শ্বাসকষ্ট হয় না তবে অন্য সমস্যা আছে।” আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো, “কি সমস্যা? বলিস নি কেনো আগে?” একটু থেমে আবারও বলে উঠল, “আমি তানভিরকে বলে রাখবো কাল সকালে মামনিকে নিয়ে ডাক্তারের….” এরমধ্যে মেঘ আবেগময় কন্ঠে বলল, “কাউকে অতিরিক্ত মিস করার সমস্যা। কোন ডাক্তার দেখাবো বলুন..”
আবিরের কথা বন্ধ হয়ে গেছে। মেঘের এমন কথায় আবিরের চোখে মুখে খানিক উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে। নিদারুণ অনুভূতিরা বক্ষস্পন্দন বাড়াতে ব্যস্ত। আবির নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে আছে অপরূপ সেই মুখমণ্ডলে। মেঘ আহ্লাদী কন্ঠে আবারও শুধালো, “বলুন না, কোন ডাক্তার দেখাবো?” আবির ভ্রু কুঁচকে গুরুভার কন্ঠে বলল, ” সব বিষয় নিয়ে মজা করিস না, মেঘ। শারীরিক কোনো সমস্যা মনে হলে ডাক্তার দেখাস প্লিজ। ” অভিমানের দমকা হাওয়া বয়ে গেল মেঘের মনে। মেঘ ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে জানতে চাইল, “মানসিক সমস্যা হলে কি করব?”
“তোর মানসিক সমস্যা শুনার জন্য তো আমিই আছি। এই ডাক্তার চলবে না? ” মেঘ ফিক করে হেসে বলল, ” আপনি ডাক্তার? সার্টিফিকেট টা দেখাবেন প্লিজ।” আবির চোখ সরু করে বলে উঠল, ” সার্টিফিকেট টা না হয় দেশে ফিরেই দেখালাম।”
টুকটাক কথা চলল কিছুক্ষণ। আবিরের মন ভালো করতে অল্পস্বল্প দুষ্টামিও করেছে মেঘ। কিন্তু আবিরের মন ভালো হওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এদিকে রাত গভীর হচ্ছে, ঘুমে মেঘের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মেঘ নিজের প্রতি খুব ক্ষুদ্ধ হচ্ছে। আবির আজ খুব মনোযোগী। মেঘ যা জিজ্ঞেস করছে সবেতেই তার আদরমাখা উত্তর রেডি। এই অপরুপ মুহুর্ত রেখে ঘুমানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই মেঘের কিন্তু চোখ যেন মেঘের ইচ্ছেকে পাত্তায় দিচ্ছে না। আবিরের কথার মাঝে ঘুমের আবেশে বার বার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা খেয়াল করে আবির অত্যন্ত নমনীয় স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ঘুম পাচ্ছে?” মেঘ চোখ বড় করে তাকিয়ে জবাব দিল, ” কই না তো।” আবির মলিন হেসে বলল, “জোর করে কথা বলতে হবে না। আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, ঘুমান।” ” ঘুম চলে গেছে। ” “কে চলে গেছে কে যায় নি সেটা পরে দেখছি। আপাতত কল না কেটে ফোনটা পাশে রেখে চোখ বন্ধ করুন। ” মেঘ আঁতকে উঠে চাইল আবিরের অভিমুখে। হৃদপিণ্ড ছুটছে দ্বিকবিদিক, হৃদপিণ্ডের পিটপিট শব্দ বেড়েই চলেছে। “কল না কেটে” কথাটা যেন মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। মেঘ থমথমে কন্ঠে বলল, “কল না কাটলে ঘুম আসবে না।” আবির গুরুভার কন্ঠে জানাল,
“সেটা আমি বুঝবো। এখন যা বলছি করুন।” আবিরের ক্ষিপ্ত নয়ন জোড়া দেখে মেঘ ঢোক গিলে বালিশের পাশে ফোন হেলান দিয়ে রেখে গায়ে পাতলা কাঁথা জরিয়ে শুয়ে পরেছে। মেঘ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে শীতল কন্ঠে বলল, ” কল কাটবেন কখন? আমার লজ্জা লাগছে।” আবিরের নিরুদ্যম কণ্ঠের জবাব, ” লজ্জা লাগছে যেহেতু চোখ বন্ধ করে রাখ। বেশরমের মতো তাকিয়ে থাকতে কে বলছে? ” মেঘ চোখমুখ কুঁচকে কন্ঠ ভারী করে বলল, “আপনি এটা বলতে পারলেন!” আবির গম্ভীর গলায় বলল,
“চোখ বন্ধ। আর একবার চোখ খুললে খবর আছে। ” মেঘ চোখ বন্ধ করে কাটকাট গলায় জানাল, “আপনি কিন্তু নিজ দায়িত্বে কল কেটে দিবেন।” আবিরের আর কোনো জবাব এলো না। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে আলোকিত রুমে ফ্যানের বাতাসে মেঘের চুলগুলো অনবরত উড়ছে, আবির অবাক লোচনে সেই দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত । মেঘের মুখের প্রতিটা পশম সূক্ষ্ম নেত্রে পরখ করছে আবির৷ মেঘের ফর্সা কপোলের নিকষ কালো তিলটা খুব বেশি আকৃষ্ট করছে। আবিরের হৃদয় কেঁপে উঠেছে, শরীরজুড়ে অজানা শিহরণ।
কিছু সময়ের মধ্যে মেঘের নিশ্বাসের শব্দ জোড়ালো হলো। রাত ২ টা বেজে ১৭ মিনিট, মেঘ গভীর ঘুমে নিমগ্ন আবির ফোনের অপর পাশ থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার প্রেয়সীকে দেখতে ব্যস্ত। ভোরের মৃদু আলো আর বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে মেঘের রুম ঝলমল করছে। চোখে আলো লাগছে, মেঘ ঘুমের মধ্যেই ভ্রু কুঁচকে নড়ে উঠল। কপালে হাত রেখে চোখ ঢাকার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। দীপ্ত আলোর চিত্তদাহে বিরক্ত হয়ে কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ ফেলে অল্পবিস্তর চোখ মেলল মেঘ। ঘুম ঘুম চোখের কোণে ফোনে নড়ে ওঠা কারো অবয়ব ভেসে উঠল। মেঘ তৎক্ষনাৎ ঘাড় কাত করে স্পষ্ট চোখে তাকালো সেদিক।সঙ্গে সঙ্গে মেঘের সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো। বালিশে হাত রেখে তারউপর মাথা রেখে আবির নিগূঢ় দৃষ্টিতে মেঘের দিকে চেয়ে আছে, ঠোঁটে লেগে আছে মায়াবী হাসি। আবিরের উষ্কখুষ্ক চুল, গাল ভর্তি ছাপ দাঁড়ি আর নেশাক্ত দৃষ্টি দেখে শোভিত পুরুষের সুষুপ্ত আদলের মোহে ডুবে গেছে। আবির ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,
“Good Morning,Sparrow.” আবিরের ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠস্বর কানে বাজতেই দুর্ভেদ্য আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল মেঘ। এই দৃষ্টি, কন্ঠস্বরে মেঘের অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। চোখ খুলে রাখার বিন্দু পরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট নেই। আবির তখনও নিষ্পলক চোখে তাকিয়েই আছে। আবির একগাল হেসে শান্ত কন্ঠে শুধালো, “ঘুম ভালো হয় নি? আমি এসে পর্দা টেনে দিয়ে যাবো?” মেঘ এবার সর্বশক্তি দিয়ে সাফ তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“আপনি কি সারারাত ঘুমান নি?” “না।” “কেনো?” “ঘুম আসছিল না।” মেঘ কন্ঠ খাদে নামিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কল কাটতে বলছিলাম কাটেন নি কেনো?” ” কল কাটতে ইচ্ছে করে নি তাই কাটি নি।” মেঘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, ” অফিস নেই?” “আছে।” মেঘ সময় দেখে পুনরায় শক্ত কন্ঠে বলল, “সময় হয়ে যাচ্ছে। উঠছেন না কেনো এখনও?” “যেতে ইচ্ছে করছে না।”
আবিরের নিরুদ্বেগ কন্ঠের একেকটা উত্তর শুনে মেঘ আশ্চর্য বনে যাচ্ছে। যে মানুষটাকে এতদিন গুরু-গম্ভীর,অনুভূতিহীন আর নিষ্ঠুর ভেবে এসেছে সেই আবির ভাইয়ের আকস্মিক পরিবর্তন মেঘের মনে বিশাল প্রভাব ফেলছে। মেঘ রাশভারী কন্ঠে শুধালো, “সমস্যা কি আপনার? ” আবির মুচকি হেসে উত্তর দিল, ” বহুত সমস্যা। এদের কোনো সমাধানও নেই।” নিজের অজান্তেই মেঘের ঠোঁট জুড়ে ললিত হাসি ফুটলো। লজ্জায় লাল হওয়া দু গাল চিকচিক করছে। মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল,
” থাক ভাই বুঝছি আপনার সমস্যা। প্লিজ, এখন উঠে অফিসে যান।” “আমি তোর ভাই?” ” ভাই না তো কি?” মেঘের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আবির ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠলো। গম্ভীর মুখ করে সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে অগ্নিকণ্ঠে বলল, “আমি তোর বাবার দাদুর নাতির ছেলে হতে পারি কিন্তু তোর ভাই না, বাই।”
আবির কল কেটে দিয়েছে। মেঘ আহাম্মকের মতো বসে আছে। আবির যে ভাই ডাকার ক্ষোভে রাগ করে ফোন কেটেছে এটা বুঝতে সময় লাগলো না মেঘের। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছে না, আবির ভাই আর শুধু ভাই এর মধ্যে পার্থক্য টা কি! বেশকিছুক্ষণ বসে থেকে চটজলদি উঠে রুম গুছিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ওজু করে ফজরের নামাজ পড়ে ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে রুমে আসলো। এরমধ্যে আবিরের আর কোনো কল আসলো না। মেঘের মনে বেশকিছু প্রশ্ন উদ্গত হচ্ছে। রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে এক বুক সাহস নিয়ে অডিও কল দিল ৷ কল বাজতে বাজতে কেটে গেছে। মেঘ এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ভিডিও কল দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রিসিভ হলো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সদ্য শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে কোনোরকমে কল টা রিসিভ করেছে আবির । এখনও ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। আবিরের জলসিক্ত উন্মুক্ত শরীর, কোমড়ে বাঁধা সাদা টাওয়েল। আবিরের ভেজা চুল, লোমশ বুকে আর নির্মেদ পেট দেখে মেঘ যত্রতত্র দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ঢোক গিলে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে বলল,
“সরি সরি। অসময়ে কল দিয়ে ফেলছি। ” আবির মেকি স্বরে বলল, ” সরি বললেই কি আমার মানইজ্জত ফিরে পাবো? ” মেঘ চোখ নামিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ” আমি বুঝতে পারি নি, সরি। ” আবির মুচকি হেসে অন্য একটা টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল, ” দূর পাগলি, এসব কোনো ব্যাপার না। তাছাড়া আমি আপনার কলের অপেক্ষায় ছিলাম।” “কেনো?”
“আজ প্রজেক্টের ফাইনাল মিটিং কি পড়ে যাব বুঝতে পারছিলাম না। আবার করেছি রাগ তাই নিজে থেকে কলও দিতে পারছিলাম না।” মেঘ লাজুক হেসে বলল, ” আপনি এমন ঢং করা কোথা থেকে শিখছেন?” “আপনার থেকেই শিখেছি।” মেঘ ভেঙচি কাটলো। আবির মুচকি হেসে ২-৩ টা শার্ট ফোনের সামনে ধরে চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কোনটা পড়ব?” মেঘ কয়েক সেকেন্ডেই একটা শার্ট সিলেক্ট করে দিল, আবির ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে একদম ইন করে শার্ট পড়ে, ব্লেজার-টাই সঙ্গে সু জুতা পড়ে সম্পূর্ণ রেডি হয়ে গেছে। ফোন থেকে খানিকটা দূরে সরে উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কেমন লাগছে?” মেঘ আপাদমস্তক দেখে মোলায়েম কন্ঠে বলল, “মাশাআল্লাহ কিন্তু… ” “কিন্তু কি?” “How do I bite the pinky finger now?” (আমি এখন কনিষ্ঠা আঙুলে কিভাবে কামড় দিব?) “In a dream” (স্বপ্নে) আবির টেবিল থেকে সানগ্লাস টা নিয়ে চোখে দিয়ে শেষবারের মতো ফাইল গুলো দেখে নিচ্ছে। এদিকে সানগ্লাস চোখে দেখায় মেঘ গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করল, “কালো সানগ্লাসটাই কেন এতো সুখ,
হে যুবক।” আবির ফোন কাছে নিয়ে বলল, “দৃষ্টিতে যেন সে রাসপুতিন, খু*ন হয়ে যাই আমি প্রতিদিন। এটা বলবেন না?” মেঘ নিজের মাথায় গাট্টা মেরে, মুখ চেপে ধরেছে। আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মলিন হেসে বলল, ” শুনলাম আপনি ইদানীং খুব বেশি গান গাইতেছেন। কই আমাকে তো শুনালেন না!” মেঘ বিড়বিড় করে বলল,
” আপনার অফিস কখন? যান না কেনো?” “যাবই তো। আগে কথা শেষ করি। ” “আপনার সাথে আর কোনো কথা নেই। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকা সত্ত্বেও সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। এখন আবার ঢং করতেছেন। এদিকে আব্বু শুধু আমার ভাইয়ের দোষ ই দেখে আপনার দোষ দেখে না। আপনি যে সারারাত ঘুমান নি এটা কি ঠিক করেছেন? এর প্রভাব মিটিং এ পড়বে না?” “জ্বি না ম্যাম। বরং আজকের মিটিং বেস্ট হবে। আপনি শুধু দোয়া করবেন। মিটিং শেষ করেই কল দিব। ঠিক আছে? ” “ফি আমানিল্লাহ। বেস্ট অফ লাক।” “থ্যাংক ইউ।”
বিকেলের দিকে আবিরের সাথে কথা হয়েছে। আজকের মিটিং ঠিকঠাক মতো শেষ হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রজেক্ট কমপ্লিট হয়ে যাবে। মোজাম্মেল খান আর আলী আহমদ খান আবিরকে বাসায় ফিরতে বলছেন। কিন্তু আবির বলেছে আরও ২ মাসের মতো সময় লাগবে। কারণ জিজ্ঞেস করায় বিস্তারিত কিছুই বলে নি। এদিকে মেঘও বেশ উদ্বিগ্ন। বন্যার সাথে আগে থেকে প্ল্যান করা ছিল আজ বিকেলে মেলায় যাবে। বন্যা রেডি হয়ে বিকেলের দিকে বেরিয়েছে ঠিকই কিন্তু মেঘ আবিরের উপর অভিমান করে ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরেছে। বন্যা বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে, বন্ধ পেয়ে একা একায় হাঁটছে। অন্যসময় হলে মেঘকে বাসা থেকে নিয়ে আসতো কিন্তু ইদানীং মেঘদের বাসায় যাওয়ার কথা মাথায় আসলেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়। ঘন্টাখানেক পর তানভিরের কল আসছে। অসময়ে তানভিরের কল দেখে বন্যা খানিকটা অবাক হয়ে আশেপাশে তাকালো। কোথাও পরিচিত কাউকে নজর পড়ছে না। ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করল। তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” একা একা ঘুরছো কেনো?” ” আপনার বোন আমাকে বাসা থেকে বের করে এখন ফোন বন্ধ করে ফেলেছে।” “তুমি আমাকে কল দিতে পারতা না?” “এত ইমার্জেন্সি ছিল না তাই দেয় নি।” “কোথায় আছো? বলো আমি আসতেছি।” “আপনার আসতে হবে না।” “বলো।” বন্যা জায়গার নাম বলতেই তানভির বলল, “আমি কাছেই আছি। ১০ মিনিট অপেক্ষা করো৷ ”
৮ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে তানভির বাইক সমেত হাজির হলো। বন্যা তানভিরকে দেখে আস্তে করে বলল, “আপনার আসার কোনো দরকার ছিল না। আমি এখনি চলে যেতাম।” ” রেগে আছো? ” বন্যা শ্বাস ছেড়ে শান্ত কন্ঠে বলল, “নাহ।” ” বনু ঘুমাচ্ছে৷ তুমি বাসায় গেলে না কেনো? আর নয়তো আমাকে আগে কল দিতে। আমি বনুকে নিয়ে আসতাম।” “আমি বাহিরে আছি এটা আপনাকে কে বলছে?” “বনু কল দিয়েছিল। বলছে ওর বের হওয়ার মুড নেই। তোমাকে যেন মেলায় নিয়ে যায়।” বন্যা কপাল গুটিয়ে ধীর কন্ঠে বলল, “আমি মেলায় যাব না।”
মনে মনে মেঘকে কিছুক্ষণ বকে নিল। তানভির সবসময়ের মতো গম্ভীর কন্ঠে বলল, “বনুর কথা অমান্য করলে বাসায় তুলকালাম কান্ড করে ফেলবে। এমনিতেই বাসায় আমাকে কেউ সহ্য করতে পারে না এ অবস্থায় বনুকে রাগালে আমায় নিশ্চিত বাসা থেকে বের করে দিবে। ” বন্যা কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে পশ্চিমা আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। সূর্য আপন গতিতে নিজ গন্তব্যে ছুটছে। আজকের আকাশ অন্যান্য দিনের থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। তানভির বন্যার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “যাবে না?”
বন্যা রক্তিম আকাশের পানে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল, “আজকের আকাশটা খুব বেশি সুন্দর। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। ” বন্যার দৃষ্টি লক্ষ্য করে তানভিরও আকাশের পানে তাকালো। গাঢ় নীল রঙের আকাশে মেঘেদের আনাগোনা, পাখিরা আপন গতিতে উড়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তাদের বাড়ি ফেয়ার বড্ড তাড়া। গোধূলি লগ্নের সূর্যটা বরাবরের মতোই রক্তিম। তানভির কয়েক মুহুর্ত আকাশ দেখে আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বন্যার কাছাকাছি স্টিলের বেষ্টনীতে মৃদুভাবে হেলান দিয়ে বন্যার অভিমুখে তাকালো। সূর্যের বিক্ষিপ্ত আলোকরশ্মিতে বন্যার মুখ লাল হয়ে আছে। তানভির বন্যার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বেশ সময় নিয়ে অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বলল,
“নীল অম্বরের ভাঁজে ভাঁজে, তোমার নামে সন্ধ্যা সাজে।” বন্যা অকস্মাৎ আড়চোখে তাকাতেই তানভির নড়ে উঠল। কাজল পরিহিতা টানাটানা চোখদুটা যেন দৃষ্টিতেই তানভিরের মতো শক্তপোক্ত ছেলের সত্তাকে বিলীন করে ফেলবে। বন্যা কোন কথা না বলে পরপর দুবার ভ্রু নাচালো। তানভির মুচকি হেসে এপাশ ওপাশ মাথা নেড়ে অন্যদিকে মুখ করে তাকালো। বন্যা তানভিরের দিকে লাজুক হাসলো। ফোন ভাইব্রেট হতেই বন্যা ফোনের দিকে তাকালো। মেঘের মেসেজ আসছে, “আমার ভাইকে দিয়ে দিলাম, দেখে রেখো।”
বন্যা ছোট করে মেসেজ পাঠালো, ” ওকে ননদিনী।” অকস্মাৎ পেছন থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠস্বর কানে বাজলো। মায়াবী কন্ঠের ডাক, “তানভির। ” তানভিরের সঙ্গে সঙ্গে বন্যাও ঘুরে দাঁড়ালো। বোরকা পড়া এক মেয়ে। চোখ, হাত-পা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বন্যা ভ্রুক্ষেপহীন, নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো?” তানভির কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ ফেলে বন্যাকে এক পলক দেখে ভারী কন্ঠে প্রশ্ন করল, “কে আপনি?” “আমাকে চিনতে পারছো না?” “আপনাকে চেনার কথা ছিল নাকি?” মেয়েটা এবার চোখ নামিয়ে শীতল কন্ঠে বলল, “আমি আয়েশা। চিনতে পেরেছো?”
অকস্মাৎ তানভিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কপালে আরও কয়েকটা ভাঁজ পড়লো, দুচোখ আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় টগবগ করছে, অক্ষিপটে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। বন্যা তখনও স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তানভির আর সেই মেয়েকে দেখছে। বন্যা বুঝতেই পারছে না কে এই মেয়ে! সে ভেবেছে পরিচিত, বান্ধবী বা অন্য কেউ হতে পারে। আয়েশা কন্ঠ খাদে নামিয়ে নমনীয় কন্ঠে বলল, ” তোমাকে অনেকদিন পর দেখলাম।” তানভির মুখ ফুলিয়ে ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছে। চোখ মুখে তীব্র আক্রোশ৷ আয়েশা আবারও বলল, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।” বন্যার দিকে তাকিয়ে বলল, “পার্সোনাল।” বন্যার এতক্ষণ কোনোকিছু অনুভব না হলেও এবার কিছুটা রেগে গেছে। মনের ভেতর প্রশ্ন জাগছে, “কে এই মেয়ে?”
তানভির অন্যদিকে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, “কথা বলার মতো সময় আর ইচ্ছে কোনোটায় আমার নেই।” তানভির পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে হুঙ্কার দিল, “বন্যা, আসো। যেতে হবে।” বন্যা ঐ মেয়েকে দেখে দেখে এগুচ্ছে। তানভির বাইক পর্যন্ত যেতে যেতে ঐ মেয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল, “তানভির, আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি।” তানভির শুনেও যেন কথাটা শুনলো না। রাগে হাত-পা কাঁপছে। মেয়ে বলে পারছে না শুধু গায়ে হাত তুলতে। মেয়ের কথা শুনে বন্যা থমকে দাঁড়ালো। বুকের ভেতরটা অকস্মাৎ মোচড় দিয়ে উঠেছে। বুঝতে বাকি রইলো না যে এই মেয়েই তানভিরের এক্স গার্লফ্রেন্ড। তানভির বাইক স্টার্ট দিয়ে অগ্নি কন্ঠে চিৎকার করল, “বন্যা, আসতে বলছি তোমায়।”
বন্যা থতমত খেয়ে ছুটে গেল। চুপচাপ বসে পড়ল বাইকের পেছনের সিটে। তবে বরাবরের মতো এবারও তানভিরের সঙ্গে দূরত্ব রেখে বসেছে। কিছুক্ষণ আগেও আকাশের পানে তাকিয়ে ভাবছিল, আজ থেকে বাইকে বসলে তানভিরকে ধরে বসবে কিন্তু তা আর হলো কই! দুজনের বুকের ভেতর যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে সে খবর কেউ জানে না। মেলার কাছাকাছি এসে বাইক থামালো। বন্যার মেলায় যাওয়ার মতো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আর না আছে তানভিরের। তবুও মেঘের কথা মেনে ঢুকলো মেলায়। বন্যা চুপচাপ ঘুরে দেখছে। মেঘের সঙ্গে অনেককিছু কেনার প্ল্যান করেছিল ঠিকই তবে এখন আর ইচ্ছে নেই। কিছুক্ষণ ঘুরে বন্যা চাপা স্বরে বলল, ” আমার বাসায় যেতে হবে।”
তানভির ঘড়িতে সময় দেখে নিল। বন্যা দ্রুত হেঁটে গেইটের দিকে যাচ্ছে। বন্যা দু-তিনটা দোকান পেরিয়ে হঠাৎ খেয়াল করল আশেপাশে তানভির নেই। থমকে দাঁড়িয়ে পেছন তাকিয়ে দেখল তানভির দোকানে কি কিনতেছে। বন্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে বলল, “তোমাকে ডাকছিলাম, তুমি শুনো নি। সরি।” বন্যা আবারও হাঁটা শুরু করল। তানভির ঠান্ডা কন্ঠে বলল, “এগুলো তোমার। ” “আমার কিছু লাগবে না, ধন্যবাদ।”
বন্যা বেড়িয়ে পরেছে। অন্যান্য দিনের মতো তানভির আজ জোর গলায় কিছু বলতেও পারছে না। দ্রুত এগিয়ে গেল বন্যার কাছে। বন্যার চোখ মুখ স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয় নি। শান্ত কন্ঠে বলল, ” আমি এখান থেকে রিক্সা নিয়ে যেতে পারব।” “কিন্তু আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারবো না।” বন্যা মলিন হেসে মনে মনে আওড়ালো, ” আপনার অতীত বর্তমান হলে আপনার জীবনে এই বন্যার অস্তিত্ব থাকবে না।” তানভির বাইক স্টার্ট দিয়ে উঠতে বলল, বন্যাও বাধ্য হয়ে উঠে বসল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। মোখলেস মিয়ার দোকানের সামনে আসতেই মোসলেম মিয়া বন্যাকে ডাকতে শুরু করলেন। বন্যা নামাতে বলায় তানভিরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইক থাকালো। তানভিরের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। তানভির শক্ত কন্ঠে বলল, “যদি গিফট না নাও তাহলে আমি এখানেই বসে থাকব।”
বন্যা কিছু না বলে দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। মোখলেস মিয়ার পাশের দোকানে বন্যার আব্বু কাপড় ইস্ত্রি করতে দিয়েছিল। ইমার্জেন্সি কাজে ওনাকে এক জায়গায় যেতে হয়েছে তাই ইস্ত্রি করে জামাকাপড় মোখলেস মিয়ার দোকানে রেখে গেছে। মোখলেস মিয়া কাপড় আর কিছু খাবার দিয়েছেন। বন্যা না করা সত্ত্বেও ওনি জোর করেই দিয়েছেন। বন্যারা সচরাচর বাসা থেকে বের হয় না, বন্যাদের কিছু খেতে ইচ্ছে হলে বন্যার ছোট ভাই রিদ ই নিয়ে যায়। মাস শেষে বন্যার আব্বু টাকা দিয়ে দেন। তানভির বাইক থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে রাগী চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মোখলেস মিয়ার নজর পড়ে তানভিরের দিকে। তানভিরের তাকানো দেখে মোখলেস মিয়া বন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন,
” পোলায় এমনে তাকায় আছে কেন? ভাড়া দাও নি?” বন্যা কিছু বলার আগেই মোখলেস মিয়া দোকান থেকে বের হতে হতে উচ্চস্বরে শুধালো, “এই ছেলে তোমার ভাড়া কত? আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি তবুও আমার বউ এর দিকে এভাবে তাকায় থাইকো না।” তানভিরের মেজাজ চরম মাত্রায় খারাপ হয়ে গেছে। রাগে দাঁত কটমট করছে। দু’চোখ লাল হয়ে গেছে। বন্যা দ্রুত বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
“দাদা, আমি কথা বলছি।” বন্যা তানভিরের কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাসায় যান, প্লিজ।” “তুমি গিফট না নিলে আমি এক পাও নড়বো না।” বন্যা আস্তে করে কপাল চাপড়ালো। মেঘের ভাই বলে কথা, সে তো মেঘের মতোই জেদি হবে। এটা বন্যা ভুলে গেছিল ভেবেই রাগ লাগছে। মোখলেস মিয়া দোকান থেকে ডাকলেন, ” সমস্যা কোনো?” “নাহ দাদা।” বন্যা তানভিরের হাত থেকে গিফটের ব্যাগটা নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, “এবার এখান থেকে যান, প্লিজ। আব্বু দেখলে সমস্যা হবে।”
তানভির কথা না বাড়িয়ে মোখলেস মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গলি থেকে বেড়িয়ে চলে গেছে। এদিকে মেঘ আবিরের উপর রাগ করে ফোন আর অন ই করে নি। আম্মুর ফোন থেকে তানভিরকে কল দিয়েছিল। সন্ধ্যার পর নিচে এসে নুডলসের পাকোড়া বানাতে শুরু করল। মীম আর আদি আগে থেকেই রেডি হয়ে বসে আছে। আবির বাসার সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মেঘের কথাও জিজ্ঞেস করল। আকলিমা খান রান্নাঘরে এসে মেঘের দিকে ফোন ধরে একগাল হেসে বললেন,
“সে এখন রেসিপি শিখতে ব্যস্ত। ৮-১০ পদের পাকোড়া বানানো শিখে ফেলছে। ” আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “পাকোড়াতে লবণ দেয় তো?” মেঘ ফোঁস করে উঠল। আকলিমা খান কপট রাগী স্বরে বললেন, ” মেয়েটাকে কেনো রাগাচ্ছো বলো তো।” আবির শান্ত কন্ঠে বলল, “কেউ যদি বিজ্ঞ হয়েও অজ্ঞের মতো আচরণ করে তো আমি কি করবো? রাখি।”
কাকিয়া লবণের বিষয়ে আঁটকে থাকলেও আবিরের কথার মিনিং মেঘ ঠিকই বুঝেছে। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করছে যেন রুমে গিয়ে আবিরকে কল দিতে পারে। এরমধ্যে তানভির বাসায় আসছে। চোখ-মুখ কালো হয়ে আছে। মেঘকে রান্নাঘরে দেখে শান্ত কন্ঠে বলল, “বনু, এককাপ কফি করে দিবি?” “আনছি ”
মেঘ কফি আর পাকোড়া নিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে হাজির হলো। তানভির চোখ মুখ দেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে ভাইয়া? কোনো সমস্যা? ” “না।” মেঘের ভয়ে বুক কাঁপছে। বন্যার সাথে যদি ঝগড়া করে তাহলে কি হবে? মেঘ শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া বলো কি হয়েছে? বন্যা কোথায়?” “ওকে বাসার কাছে দিয়ে আসছি। ” “তাহলে আর কি হয়ছে? তুমি এত রেগে আছো কেনো?” তানভির কফির কাপে চুমুক দিয়ে কাপ সামনে রেখে আস্তে করে বলল, “আজ আয়েশার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।” আয়েশা নাম শুনেই চমকে উঠল মেঘ। প্রশস্ত আঁখি যুগল আরও বেশি প্রশস্ত করে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করল, ” থা*প্পড় দিয়েছো? ”
“না।” মেঘ অকস্মাৎ সোফায় ঘুষি শুরু করল। পরপর বেশ কয়েকটা ঘুষি দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠল, “তোমাকে আমি বলেছি সামনে পেলে চোখ বন্ধ করে থা*প্পড় দিবে। তুমি থা*প্পড় দিলে না কেনো?” তানভির তড়িৎ বেগে উঠে মেঘের দু-হাত শক্ত করে ধরে বলল, ” একটু ঠান্ডা হয়ে কথা তো শুনবি।” “তুমি থা*প্পড় দাও নি কেনো?” “পাবলিক প্লেসে মেয়েদের গায়ে হাত তোলাটা শোভা পায় না। ” “ইসস আমি কেন গেলাম না আজ। ঐ মেয়েকে কয়েকটা থাপ্প*ড় দিয়েই আসতাম। বন্যা কোথায় ছিল? বন্যাও দেখেছে?” “বন্যা সাথেই ছিল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করে নি।”
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলল, ” শেষ! আমার সব শেষ। ” তানভির সূক্ষ্ম নেত্রে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বিড়বিড় করছিস কি?” “কিছু না। হাত ছাড়ো রুমে যাব।” “ঘুষাঘুষি করবি না তো?” “ঘুষাঘুষি করে নিজের হাত ভেঙে কি করব। যার নাকমুখ ভাঙা দরকার তার টায় যদি না ভাঙতে পারি। বুঝছি, তুমি কিছু পারবা না। আবির ভাই কে বলতে হবে।” তানভির হাত ছেড়ে ভীত কন্ঠে বলল, “প্লিজ, ভাইয়াকে এখন কিছু বলিস না। এই ঘটনা ভাইয়া শুনতে পারলে আমার কপালে বহুত দূর্গতি আছে। ” “ঠিক আছে বলবো না। ”
মেঘ রুমে এসে ফোন অন করতেই বন্যার কল আসলো। বন্যা একে একে সব ঘটনা খুলে বললো। মেঘ যতটা সম্ভব বুঝানোর চেষ্টা করেছে। পর পর আবিরকে কল দিল। আবির কল রিসিভ করে শক্ত কন্ঠে ধমক দিল, “এই মেয়ে, এত নির্বোধ কেন তুই?” “আমি কি করেছি। ” “কথা না শুনে, না বুঝেই ফোন বন্ধ করে বসে আছিস।” “কি শুনবো আর কি বুঝবো? আপনি যেই কাজে গিয়েছিলেন সেই কাজ শেষ তবুও আপনি বাসায় ফিরবেন না। এটাতে কি বুঝবো আমি?”
“আমি শুধুমাত্র প্রজেক্টের কাজে এতদিনের জন্য এতদূর আসি নি। বাংলাদেশে টানা তিন প্রজেক্ট করলেই এটার সমান বেনিফিট পেতাম। সব ছেড়ে এখানে এসে পড়ে থাকতাম না। আমি আমার প্রয়োজনে আসছি আর প্রজেক্টটা শুধুমাত্র আমার বাহানা ছিল। যে প্রজেক্ট ১৫ দিনে শেষ করতে পারতাম সেটা কমপ্লিট করতে ৩ মাসের উপরে সময় নিচ্ছি যেন আব্বু, চাচ্চু কিছু বুঝতে না পারে। ” “আপনি কেনো গিয়েছেন? কি প্রয়োজন আপনার?” “আমার টাকার প্রয়োজন।” মেঘ কপাল কুঁচকে বলল,
“আপনার কত টাকা প্রয়োজন? আপনি আমাকে একটা ক্রেডিট কার্ড দিয়েছিলেন মনে নেই? ঐটাকে অনেক টাকা আছে। আপনি এখান থেকে টাকা নিতে পারতেন৷ আমার এত টাকা লাগেই না। ” আবির মুচকি হেসে বলল, “ঐটা শুধুমাত্র তোর আর ওখানে প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট এমাউন্ট পাঠানো হচ্ছে শুধু তোর জন্য। তোর যা ইচ্ছে হয় তা কিনিস, আরও বেশি প্রয়োজন হলে একবার জানাস শুধু।” “আমার টাকার বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি এগুলো নিয়ে যান৷ তবুও চলে আসেন প্লিজ।” আবির শ্বাস ছেড়ে শীতল কন্ঠে বলল, “কেনো বুঝতে পারছিস না, আমার লাখ টাকার প্রয়োজন না। আরও বেশি প্রয়োজন।” “তাহলে কত প্রয়োজন?” “কোটি।”
“What? কোটি টাকা দিয়ে আপনি কি করবেন?” “দরকার আছে।” “এত টাকা কে দিবে আপনাকে?” “আমার টাকা আমি নিতে আসছি। কে দিবে আবার কি? এখানের স্থানীয় এক ফ্রেন্ডের বাবা বড় বিজনেসম্যান। ওনার কথা মতো আমরা দুজন স্টুডেন্ট থাকাকালীন ছোট ছোট বেশ কয়েকটা কোম্পানিতে শেয়ার কিনেছিলাম। যদিও সবকিছু ওনিই ম্যানেজ করে দিয়েছিল। আমি দেশে যাওয়ার আগে সবগুলো শেয়ারের এমাউন্ট একসাথে করে আংকেলের কোম্পানিতে কিছুটা শেয়ার কিনে গিয়েছিলাম৷ কারণ আমার কাছে ওনারায় একমাত্র বিশস্ত মানুষ ছিলেন। এখন আমার টাকার প্রয়োজন, আংকেলকে জানানোর পর আংকেল এখানে আসতে বলেন। কোম্পানির বেশকিছু কাজ প্যান্ডিং আছে সেগুলো কমপ্লিট করতে পারলে আমি যত আশা করেছি তার থেকেও অনেক বেশি দামে শেয়ারটা বিক্রি করতে পারবো। তানভির আর রাকিব ব্যতীত এই কথা আর কেউ জানে না। আজ তোকে বলছি। আব্বু- চাচ্চু এসব জানতে পারলে কিভাবে রিয়েক্ট করবেন আমি জানি না। তাই প্রজেক্টের নাম করে এখানে আসছি।” মেঘ সবকথা শুনে রাশভারি কন্ঠে বলল,
“শেয়ারটা বিক্রি না করলে হয় না? আপনার এত কি প্রয়োজন?” ” প্রতিনিয়ত মানুষকে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে বাঁচতে পারবো না। আমি সব মায়াজাল কাটিয়ে একটা স্বচ্ছ জীবন কাটাতে চাই। জীবন চালাতে ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটা ইনকাম করতে পারলেই হবে। আমি শুধু মানসিক শান্তি চাই।” মেঘ চুপ করে বসে আছে। কিছু বলার মতো শব্দ খোঁজে পাচ্ছে না। আবির মোলায়েম কন্ঠে শুধালো, ” রাগ করেছিস?” “না। রাগ করবো কেন! আপনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা অবশ্যই ভেবেচিন্তেই নিয়েছেন।” “বাসার কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলিস না ।” “আচ্ছা ঠিক আছে। রাখি এখন।” “আচ্ছা।”
আজ সকাল থেকে আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খানের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। সারাদিন খাওয়া নেই। যে যার রুমে শুয়ে আছেন। বাসার সবাই চেষ্টা করেও রাগ ভাঙাতে পারে নি। দুপুরের পর পর ফুপ্পি, জান্নাত আপু, আইরিন আর আসিফ ভাইয়া আসছে। আজ ইচ্ছে করেই আরিফ আসে নি। প্রতিনিয়ত মীমের সাথে ঝগড়া করতে ভালো লাগে না তার। মেঘের ফুপ্পি প্রথমেই মোজাম্মেল খানের রুমে গেলেন। মোজাম্মেল খান বোনকে দেখে শুয়া থেকে উঠে বসে ভারী কন্ঠে বললেন, “কেমন আছিস?” “কেমন থাকবো? এই বয়সে এসে তোমরা ভাইয়ে ভাইয়ে কোন দ্বন্দ্বে মেতেছো?” “আমি কি বলব, ভাইজানের যা মন চাই তাই করছেন। কিছু বললেও ওনি রেগে যান। বুঝার চেষ্টা পর্যন্ত করেন না। জানিস ই তো ওনার স্বভাব। যা বলবে তাই করবে।” “সমস্যা কি নিয়ে?”
“সমস্যা তো অনেক কিছু নিয়েই। আমার ছেলেকে শাসন করলেও দোষ, না করলেও দোষ। মেয়েকে কিছু বললেও দোষ, না বললেও দোষ। আগে আবির অফিস সামলে নিতো তাই অফিসের বিষয়ে এত কথা আমায় শুনতে হতো না। এখন আবির নেই, কাজের একটু এদিকসেদিক হলেই রাগ। আমরা নাকি গুরুত্ব দেয় না, ওনি একা পরিশ্রম করে সবকিছু করেছেন। ওনি যা বলবেন তাই হবে। আরও অনেককিছু। ” “ভাইজান কি কোনোভাবে সংসার ভাঙার কথা বুঝাতে চাচ্ছেন?”
“এই কথা ভুলেও ভাইজানের সামনে বলিস না। আমি সেদিন রাগে বলে ফেলছিলাম, তুমি বললে সংসার ভাগ করে ফেলি। বলেছি না মরেছি, আমার সাথে কথা তো বলেনই না এমনকি এটাও বলেছেন, আমার ছেলে, আমার মেয়ে দুজন ই ওনার। ছেলেমেয়ের ব্যাপারে কিছু বলার অধিকার পর্যন্ত আমার নেই। ইকবাল ই ভালো। তার এসব বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনায় নেই। ” “তানভির, আবির কি বলে?” “আবিরের সঙ্গেও ঝামেলা। ” মাহমুদা খান চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “আবিরের সঙ্গে আবার কিসের ঝামেলা? ”
” প্রজেক্ট শেষ তবুও আবির দেশে আসছে না। তাছাড়া সেদিন আবির আমার পক্ষে দুটা কথা বলেছিল সেই রাগে আবিরের সঙ্গেও কথা বলেন না।” “এখন করণীয় কি?” “দেখ তুই মানাতে পারিস কি না?” মাহমুদা খান মোজাম্মেল খানের রুম থেকে বেরিয়ে আলী আহমদ খানের রুমে গেলেন। রুমে ঢুকতেই আলী আহমদ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ” তুই ও কি তার পক্ষে কথা বলতে আসছিস?” “নাহ ভাইজান। আমি আপনার মুখে শুনতে চাই। ঘটনা কি?” “ঘটনা কিছুই না। মোজাম্মেলের অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছে না৷ ” “কেনো? ভাই কি করেছেন?”
“তানভিরের সাথে ওর কি শত্রুতা আমি জানি না। কথায় কথায় ছেলেকে বকাবকি করে। আমি কিছু বলতে গেলে আমার ছেলের সাথে তুলনা দেয়। আমার ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ওর ছেলে বেকার। কিছুই ঠিকমতো করতে পারছে না। কোথায় আমি আমার ছেলে নিয়ে গর্ব করব উল্টো সে গর্ব করে। সে সারাক্ষণ আমার পিছনে লাগে। এই যে ছেলেমেয়ে গুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগাচ্ছে ওরা কি সারাজীবন একসাথে থাকতে পারবে? আমি এজন্য সেদিন রাগে বলেছিলাম,
ওর মতো চিন্তাভাবনা আমার থাকলে আমি একা এই সংসার টাকে এতদূর টানতে পারতাম না। এই সংসার আমার, এখানে আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি, আমি যা বলবো তাই হবে। আমি বুঝাতে চেয়েছি, ওর উল্টাপাল্টা আচরণ গুলো যেন পরিবর্তন করে। অথচ সে বুঝেছে আমি সংসার ভাঙতে চাচ্ছি। এজন্য আমিও বলেছি ও যদি চায় বাড়ি থেকে চলে যেতে পারে। কিন্তু তানভির, মেঘ আর ওদের মা আমার বাড়িতেই থাকবে। ওদের উপর বাবার অধিকার খাটাতে যেন না আসে।”