প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫
প্রেয়সীর কাব্য | পরিত্যক্ত স্টেশনের সেই সুর
বৃষ্টির দিন। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
কফির কাপ হাতে জানালার পাশে বসে আছে এক সুদর্শন যুবক—যার জন্য অগণিত তরুণী পাগল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো নারীর স্পর্শও সে গ্রহণ করেনি।
এই নিয়ে চারপাশে হাজারো প্রশ্ন থাকলেও তার একটাই উত্তর:
— "আমার প্রিয়তমা ছাড়া আমি চাই না আর কেউ আমাকে স্পর্শ করুক। এতে আমার প্রিয়তমার অপমান হবে।"
সে কফিতে চুমুক দিয়ে জানালার দিকে তাকালো। ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে—
— কাব্য?
— বল।
— বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। যাবি না?
— যাবো।
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে তার প্রিয় বন্ধু অর্ণব।
আজ তারা কাব্যর দিদার কফিন দেখতে যাচ্ছে। প্রতি বৃষ্টিতেই কাব্য সেখানে যায়। যদিও সে কখনো তার দিদাকে সামনে থেকে দেখেনি, কেবল শুনেছে—তিনি ছিলেন অপরূপা। চাঁদের আলো যেন তার মুখের এক অংশমাত্র।
কিন্তু সৌন্দর্যই তার আকর্ষণের কারণ নয়।
কাব্য শুনেছে, সেই দিদা নাকি তাকে খুব ভালোবাসতেন। বলতেন—“যে মেয়েটি কাব্যর জীবনসঙ্গী হবে, সে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারী।”
এইসব গল্প শুনেই কাব্য দিদার প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করে।
---
কাব্য আর অর্ণব বেরিয়ে পড়ে বৃষ্টিভেজা পথে।
কাব্যর হাতে ফুল।
অর্ণবের হাতে ছাতা।
অর্ণব সবসময় কাব্যকে এমনভাবে আগলে রাখে, যেন আপন ভাই। আজকাল তো রক্তের ভাইও এভাবে পাশে থাকে না। অর্ণব একটু খেয়ালি, সবকিছুতেই হাসি-ঠাট্টা খুঁজে পায়, তবুও কাব্য তাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে—কারণ, সে শোনে, বোঝে, আর কখনোই বিচার করে না।
তারা হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াল একটি পরিত্যক্ত রেলওয়ে স্টেশনের সামনে।
এখানে আর কোনো ট্রেন এখন আর আসা যাওয়া করে না। পুরো জায়গাটা যেন শুকনো পাতায় ঢাকা।
চারপাশে নীরবতা, নিস্তব্ধতা—এমন নিঃসঙ্গ, যেন ভূতের আস্তানা।
স্টেশনের পেছনে সারি সারি কফিন।
ধুলোয় ঢেকে গেছে প্রায় সবই, কেবল একটি কফিন পরিষ্কার—কাব্যর দিদার। কারন সে আর অর্ণব মাঝে মাঝেই কফিনটা পরিষ্কার করে।
কাব্য সামনে এগিয়ে যায়।
ফুল রেখে কিছু বলবে এমন সময়, হঠাৎই এক সুরেলা কণ্ঠ ভেসে আসে স্টেশনের ভেতর থেকে—
> "ধরা দিলো কেউ অল্প চাওয়াতে,
উড়ে গেলো কিছু গল্প হওয়াতে,
অকারণে আমি অল্প আঘাতে হচ্ছি অভিমানী...
কাঁচা মিঠে আলো নাম কি জানি তার,
বড় অগোছালো কাটছে দিন আমার।
বেজে উঠে মনে পিয়ানো গিটার,
হালকা ঘুম পাড়ানি..."
কাব্য চমকে উঠে ফিসফিস করে বলল—
— কে গাইছে রে?
— জানি না... মনে হচ্ছে শাকচুন্নি।
— ধুর! দিনের বেলায় কিসের শাকচুন্নি!
অর্ণব মনের মধ্যে একটু সাহস সঞ্চয় করে বলল—
— চল, গিয়ে দেখি।
— হুম...
— "হুম" বলে থেমে গেলি? তুইও তো ভয় পাচ্ছিস।
— কাব্য ভয় পায় না। চল যাই!
দুজনেই দেয়ালের পাশ থেকে উঁকি দিয়ে তাকালো।
রেললাইন বরাবর বসে আছে এক অপরূপা রমণী।
তার কেশ যেন কালো রাতের জোছনায় ভেজা সমুদ্রের ঢেউ। তার কেশরাশি যেনো কোনো রনধার ছাড়াই এ গোটা ব্রহ্মান্ড জয় করতে সক্ষম। ত্বকের বর্ন খুব আহামরি মেঘ সাদা না হলেও তার শ্যামবরণ সৌন্দর্য যেন মাটির উষ্ণ ছায়া।
প্রথম দেখায়ই কাব্যর হৃদয় থমকে গেল।
চোখে যেন মুগ্ধতা, বিস্ময়—এক চিরপরিচিত রূপের নতুন আবিষ্কার।
— কে এই রমণী? — ফিসফিস করে বলে উঠলো কাব্য।
অর্ণব হঠাৎই বাস্তবতায় টেনে এনে বলল—
— এটা তো শাকচুন্নি! চুল দেখে বুঝতে পারছিস না?নিশ্চই তোর প্রিয়তমা এই পরিত্যাক্ত রেলওয়ে স্টেশনে এসে চুল ছেড়ে বসে থাকবে না?
— থাকতেও তো পারে?
— কী! তোর কি মনে হয় তোর প্রিয়তমা ইতমধ্যেই মারা গেছে? এখন ভূত হয়ে তোর ঘাড়ে চাপবে?
অর্ণবের কথা শুনে কাব্য কিঞ্চিত বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকায়।
এদিকে মেয়েটিরও তাদের কথা শুনে বুঝতে বাকি নেই যে তাকে ভূত ভাবা হচ্ছে।
সে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো—
> "কতদিন তাজা মানুষের মাংস খাই না...
আজ মনে হয় খাব! আশপাশে কার গন্ধ পাচ্ছি যেন!"
অর্ণব আঁৎকে উঠে বলে—
— তোকে আগেই বলেছিলাম!
বলেই কাব্যর হাত ধরে টেনে নিয়ে স্টেশনের বাইরে ছুটে চলে যায়।
আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটিও তাদের এ কাণ্ড দেখে হাসতে থাকে।
সে এখনো কাব্যকে দেখেনি—শুধু শুনেছে তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর।