প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট ২০২৫
তেইশান্তে প্রেমালোক | বৃষ্টিভেজা রাতের মায়াবিনী
"আ... আমি আপনার অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। একটু কষ্ট করে আসবেন?"
নীলার হঠাৎ এমন কথায় রায়ানের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই মুহুর্তে রায়ানের মাথা কাজ করছে না। কোনো কিছু না ভেবেই দ্রুত দৌড় দিল নিচের দিকে। নিচে এসেই গেটের কাছে গেল। কাচের গেটের বাইরে নীলাকে ভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রায়ান আতকে উঠল। নিঃশব্দে দ্রুত গেট খুলে নিলাকে ভিতরে আনল। পুনরায় গেট লাগিয়ে নীলার দিকে তাকাতে তাকাতে বলল,
"তুমি এভাবে বৃষ্টি......"
আর কিছুই বলতে পারল না রায়ান। ওর চোখের সাথে সাথে মুখের কথাটাও আটকে গেছে। নিলা শাড়ি পরেছে। নিল রঙের শাড়িটা একদম শরীরের সাথে লেপটে আছে। ভেজা চুলগুলো ঘার আর গালে লেগে আছে। রায়ান এক শুকনো ঢোক নিলো। রায়ানের মনে হচ্ছে তার বুকে কেও অনবরত ছুরি চালাচ্ছে। কিন্তু রায়ান এবার নিলার আতঙ্ক ভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে আতকে উঠলো। নিলা ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু নিয়ে বেশ ভয় পেয়েছে। নিলার ঠোঁটগুলোও কাপছে। নিলার এমন অবস্থা দেখে রায়ান এবার চিন্তিত স্বরে বলল,
“কি হয়েছে? কোন সমস্যা হয়েছে? আমাকে বলো নিলা”
রায়ানের কথায় নিলা এবার চোখ তুলে তাকাল রায়ানের দিকে। রায়ানের চিন্তিত মুখখানি এক পলক দেখে নিলো। তারপর নিজের হাতের ফোনটা রায়ানের দিকে আগিয়ে দিলো। রায়ান ফোনটা হাতে নিতেই ওর চোখ পড়লো কললিস্টের প্রথম নাম্বারটার দিকে। নাম্বারটা দেখেই রায়ানের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। নাম্বারটা ছিল ‘২৩২৩২৩’ । নিলা এবার ধিরে ধিরে বলল,
“কিছুক্ষন আগেই এই নাম্বার দিয়ে আমার কাছে কল আসে। কল করা ব্যাক্তিটি আমাকে হুমকি দেয় আর ২৩ সংখ্যার কেসটা থেকে দূরে থাকতে বলে”
রায়ান এক নজরে নিলাকে দেখছে। সবসময় সিরিয়াস থাকা রায়ানের আজ এতো সিরিয়াস বিষয়েও কোন চিন্তা হচ্ছে না। রায়ান চাইলেও এখন সিরিয়াস মুডে যেতে পারছে না। রায়ান এবার সেই ভাবেই নিলার নিল চোখের দিকে নেশা লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কি কি বলেছে তোমাকে?”
রায়ানের কথায় এবার নিলা সবকিছু বলা শুরু করলো। কি কি বলে হুমকি দিয়েছিল, নিলা কতটা ভয় পেয়েছিল, ওই লোকটার কণ্ঠ কত ভয়ংকর ছিল সবই বলছে। কিন্তু রায়ানের কান পর্যন্ত কোন কথাই পৌছাচ্ছে কিনা সন্দেহ। রায়ান একই দৃষ্টিতে নিলার মুখ নাড়ানো আর নিল চোখগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। নিলা হাত নারিয়ে নারিয়ে কথাগুলো রায়ানকে বুঝাচ্ছিল। কিন্তু রায়ান হঠাৎ নিলার ছোট্ট হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। রায়ানের এমন কাজে নিলা বেশ অবাক হয়েছে। নিলা চুপ হয়ে গেছে। হালকা ভ্রু কুচকে রায়নের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে। তারপর বলল,
“কি হয়েছে আপনার”
নিলার কথায় রায়ান এবার তরিহরি করে নিলার হাতটা ছেড়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলল,
“তোমাকে আগেই বলেছি… এই কেসে প্রানের ঝুঁকি আছে। তখন তো তুমি আমার কথা বুঝতে চাও নি। কিন্তু আশা করি এখন বুঝতে পেরেছ”
“হুম বুঝেছি। কিন্তু তবুও আমি আমার প্রানের বাজি রেখেই এ কেস লড়বো”
নিলার কথায় রায়ান এবার এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আর মনে মনে বলল,
“এই মেয়েকে বুঝিয়ে লাভ নেই”
পরক্ষণেই বলে উঠলো,
“আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো? যদি মাইন্ড না কর”
রায়ানের এমন নরম স্বর আর আন্তরিকতা দেখে নিলা হালকা মুচকি হেসে বলল,
“অবশ্যই”
রায়ান এবার একবার শুকনো ঢোক গিলে নিলো। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“না মানে… এই রাতে শাড়ি কেন পরেছ?”
রায়নের কথায় এবার নিলা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে মিষ্টি হাসে। চোখের পলক পরতে দেরি হলেও নিলার ফর্সা গায়ের রং লজ্জায় টমেটোর মতন লাল হতে দেরি হল না। নিলাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে রায়ান এবার হালকা ভ্রু কুচকালো। কিন্তু হঠাৎই নিলা মাথা উচু করে তাকালো। নিজের নিল মণি বিশিষ্ট ডাগল ডাগল চোখ গুলো রায়ানের টানা টানা ক্লান্ত চোখে রাখল। নিলা ভীষণ শীতল চোখে তাকাল। নিলার হঠাৎ এমন কাণ্ডে রায়ানের শরীরের শিরা উপশিরাগুলো ছোটাছুটি শুরু করেছে। নিলা এবার মুখে সেই মিষ্টি হাসি রেখে বলল,
“কেন? আমাকে সুন্দর লাগছে না?”
নিলার হঠাৎ এমন প্রশ্নে রায়ান অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। বরং নেশা লাগা দৃষ্টিতে নিলার দিকে তাকাল। মনে মনে হাজারো কবিতা লেখা হয়ে গেছে রায়ানের। রায়ান নিলার এই সৌন্দর্য নিয়ে পুরো একটা উপন্যাস লেখতে পারবে। রায়ানের দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য এইটা। আজ যদি রায়ান অন্ধ হয়ে যায়, তবুও তার কোন আফসোস থাকবে না। কেননা সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটা দেখে ফেলেছে। রায়নের চোখ সার্থক হয়েছে। রায়ান তার অপরিচিতার এই রুপের জন্য কবিতা বানাতে ব্যাস্ত। কিন্তু এইদিকে রায়নের মুখে কোন কথা না শুনে নিলার নাকের ডগা অভিমানে লাল হয়ে গেছে। আর রায়ান তখনো নিজের ভাবনায় মগ্ন। এবার রায়ান নিলার অপেক্ষারত চেহারার দিকে নেসাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে আসতে করে বলে,
“মায়াবিনী…”
হয়তো কবিতা সাজাতে সাজাতে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কথাটা নিলার মুখের অভিব্যাক্তি পরিবর্তন করে দিলো। নিলা এবার মুখ নিচু করে মিষ্টি হাসল। তারপর কেটে গেছে অনেক্ষন। রায়ানের ঘোড় কাটার নামই নিচ্ছে না। এখনো সে একই ভাবে নিলার দিকে তাকিয়ে আছে। নিলা এবার কিছুটা আল্লাদি স্বরে ডাকল,
“রায়ান…”
প্রিয়তমার মুখে প্রথমবারের মতো নিজের নাম শুনে রায়ান বিষম খেলো। দু- তিনবার বিকে হাত রেখে কেশে স্বাভাবিক হলো রায়ান। রায়ানের হঠাৎ এমনভাবে বিষম খাওয়ায় নিলা থতমত খেয়ে দাড়িয়ে রইলো। নিলার সামনে এই নিয়ে তিনবার বিষম খেলো রায়ান। এই লোক কি কথায় কথায় বিষম খায় নাকি? নিলা এবার রায়ানের অবস্থা দেখে হালকা হেসে বলল,
“আসলে… রাতে এতো সুন্দর বৃষ্টি দেখে শখ করে শাড়ি পরেছিলাম। কিন্তু তখনি কলটা আসায় ভয় পেয়ে ওই অবস্থাতেই চলে আসছি”
নিলার কথাটুকু মনোযোগ দিয়ে শুনে রায়ান এবার কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলল,
“ঠিক আছে। এখন চলো”
“কোথায়”
“তোমার বাসায়। আমি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি”
রায়ানের কথায় নিলা তরিৎ বেগে বলল,
“এই না না! আমি একাই যেতে পারবো”
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিলার চোখ পড়লো রায়ানের অগ্নি চোখে। রায়ানের রাগ দেখে নিলা আর কিছুই বলতে পারল না।
বাইরে শীতল হাওয়া বইছে। আশপাশ নির্জন। এতক্ষণে বৃষ্টি অনেকটায় কমে এসেছে। তবে এখনো ঝিরঝির বৃষ্টি পরছে। নিলা ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে রাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আর রায়ান ড্রাইভিং এ ব্যাস্ত। নিলা এতক্ষন বাইরেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু কিছু একটা ভেবে ঘুরে রায়ানের দিকে আড় চোখে তাকাল। রায়ান সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। সে বরাবরি গাড়ি চালানোর সময় সতর্কতা অবলম্বন করে। কিন্তু সে কি জানে? এক জোরা নিল মণি তাকে দেখেই যাচ্ছে। হয়তো বুঝতে পারছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। নিলা হঠাৎ চোখ নামিয়ে মুচকি হাসলো। রায়ানো এবার আড় চোখে একবার নিলাকে দেখে নিলো। নিলার ঠোঁটে হাসি দেখে রায়ানও হাসলো। প্রায় ১০ মিনিটের পথ পেরিয়ে গাড়ি নিলার বাসার সামনে থামলো। নিলা গাড়ি থেকে বের হতে নিয়েও থেমে গেলো। রায়ানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে ধন্যবাদ জানালো। রায়ানো মুচকি হাসলো। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসের দিকে রওনা হল। রায়ান গাড়ি চালাচ্ছিলো কিন্তু তখনি ওর ফোনে কল আসলো। আর রায়ান এইবার গাড়ি থামিয়ে প্রথমবারেই কলটা রিসিভ করলো। কেননা ও আজই শপথ নিয়েছে, আজকে থেকে ও সবার কলই প্রথমবারেই রিসিভ করবে। তাই এইবার মাসুম এর কলটাও প্রথমেই রিসিভ করলো। কিন্তু এই বিষয়টা মনে হয় মাসুমের হজম হল না। তাই তো কল রিসিভ হতেই বলল,
“স্যার! কোন কি সমস্যা হয়েছে?”
“কি বলতে ফোন করেছো?”
রায়ানের কথায় মাসুম বেশ বিরক্ত হলো। এই লোককে কি জিজ্ঞেস করলাম, আর এই লোক কি বলল। মাসুম নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল,
“স্যার, কিছুক্ষন আগে আরও ৬ জন ব্যাক্তি আত্মহ*ত্যা করেছে”
মাসুমের কথাটা শুনেই রায়ান কল কাটলো। তারপর তারাতারি টাইম দেখলো। ইন্টারন্যাশনাল সময়ে এখন ২৩ টা ২৩ বাজে। মানে এখনো প্রায় এক ঘণ্টা বাকি ২৩ তারিখ শেষ হতে। রায়ান ভেবেছিলো তাকে এই মাসে আর কোন মৃত্যুর খবর শুনতে হবে না। কিন্তু সে আবারো সেই খবর শুনল। আজকের দিনটা রায়ানের কাছে বেশ বড় বলে মনে হচ্ছে। সময় যেন কাটছেই না। রায়ান এবার অফিসে না গিয়ে গাড়ি ঘুরালো বাড়ির দিকে।
রায়ান বাসায় এসেছে অনেক্ষন হয়েছে। সে বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে। এখনো ২৩ তারিখ শেষ হতে ২০ মিনিট বাকি। আজ প্রতি সেকেন্ড রায়ানের জন্য প্রতি ঘণ্টার সমান হয়ে গেছে। রায়ান আতঙ্কে আছে যে আবার না কল আসে আর ওকে বাজে খবর দেয়। কিন্তু কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। রায়ানের সাথেও তাই হলো। কেননা রায়ান আই মুহূর্তে কল আশা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলো। আর হুট করেই রায়ানের ফোনে কল আসা শুরু করলো। রায়ান এবার কাপা কাপা হাতে সূরা পরতে পরতে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। আর তাকাতেই প্রসান্তির নিশ্বাস ছেড়ে মুচকি হাসলো। কেননা কলটা ছিল নিলার। কলটা রিসিভ করতেই নিলা ওপাশ থেকে বলল,
“আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
নিলার এমন কথায় রায়ান বেশ ভরকে যায়। অবাক হয়ে বলে,
“তুমি কিভাবে বুঝলে?”
“তার মানে আপনি সত্যিই চিন্তিত?”
“না মানে… একটু আগেই আরও ৬ জন মারা গেছে। তাই আরকি একটু চিন্তায় আছি”
নিলার সাথে রায়ান আরও কিছুক্ষন কথা বলল। কেস নিয়েই আলোচনা করলো ওরা। তারপর কল কেটে আবারো ঘড়ির দিকে তাকাল রায়ান। এখন রাতের ১২ টা ৫ বাজে। অর্থাৎ এখন ২৩ তারিখ পেরিয়ে ২৪ তারিখ হয়ে গেছে। রায়ান সেদিকে তাকিয়ে শান্তির নিশ্বাস ফেললো। তারপর শান্তিতে ঘুমাতে চলে গেলো।